৪ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
গর্ভাবস্থার চতুর্থ মাস হল এক বিশেষ সময়। এই সময় মাতৃগর্ভে শিশুর অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও হাড়ের গঠন শুরু হয়, আর মায়ের শরীরও অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। এ সময়ে সঠিক খাদ্য গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সন্তানের সুস্থ বৃদ্ধি ও মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর খাবার অপরিহার্য।
চতুর্থ মাসে গর্ভবতী মা সাধারণত দুর্বলতা, বমি ভাব ও ক্লান্তি অনুভব করতে পারেন। তাই খাদ্যের মান ও পরিমাণ খেয়াল রাখা খুব জরুরি। স্বাস্থ্যকর খাদ্য শুধুমাত্র দেহকে শক্তি দেয় না, বরং শিশুর মস্তিষ্ক, হাড়, চোখ ও অন্যান্য অঙ্গের বিকাশেও সাহায্য করে।
বাংলাদেশে প্রচলিত খাবারের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা গর্ভবতী মা হিসেবে নির্দিষ্ট কিছু খাবার পছন্দ করেন বা বিরত থাকেন। তবে এই সময়ের খাদ্য তালিকা যদি সঠিকভাবে সাজানো হয়, তা শিশুর স্বাস্থ্যবান জন্ম ও মায়ের শক্তিশালী শরীর নিশ্চিত করতে পারে।
এ নিবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব— ৪ মাসের গর্ভবতী মায়ের জন্য সঠিক খাবার তালিকা, ফলমূলের গুরুত্ব এবং প্রতিদিনের খাদ্য পরিকল্পনার পরামর্শ। এতে মায়ের পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে এবং শিশুর সুষ্ঠু বিকাশ নিশ্চিত হবে।
৪ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা

চতুর্থ মাসে গর্ভবতী মায়ের শরীরে নানা শারীরিক পরিবর্তন শুরু হয়। এই সময়ে শিশুর হাড়, পেশি ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন শুরু হয়, তাই খাদ্যতালিকায় প্রোটিন, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফলিক এসিড, ভিটামিন ও খনিজ উপাদান থাকা অত্যন্ত জরুরি। মায়ের দৈনন্দিন খাবার শুধু তার নিজের স্বাস্থ্যের জন্য নয়, গর্ভস্থ শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্যও সমানভাবে প্রয়োজন। নিচে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান ও তাদের বিশদ গুরুত্ব তুলে ধরা হলো —
১. সকালে ঘুম থেকে উঠে হালকা ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের গুরুত্ব
গর্ভাবস্থার ৪র্থ মাসে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর খালি পেটে ভারী খাবার না খাওয়াই ভালো। এই সময় হালকা উষ্ণ পানি, সামান্য খেজুর বা কলা খাওয়া শরীরকে শক্তি দেয় ও বমি ভাব কমাতে সাহায্য করে। চাইলে দুধের সঙ্গে ওটস বা সামান্য চিড়া দুধ দিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এটি শরীরকে দ্রুত শক্তি দেয় এবং গর্ভস্থ শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে। সকালের খাবারে খুব বেশি তেল-ঝাল না থাকাই উত্তম, কারণ এটি গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বাড়াতে পারে।
২. প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার যেমন ডিম, মাছ, মাংস ও ডাল অন্তর্ভুক্ত করা
গর্ভাবস্থায় প্রোটিন শরীরের নতুন টিস্যু গঠন ও শিশুর পেশি বিকাশে অপরিহার্য। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ডিম, মাছ, মুরগি, দুধ, মসুর ডাল ও ছোলার ডাল থাকা উচিত। বাংলাদেশে সহজলভ্য মাছ যেমন রুই, কাতলা বা তেলাপিয়া প্রোটিন ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের ভালো উৎস। তবে কাঁচা বা আধা সেদ্ধ মাংস বা ডিম এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এতে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
৩. আয়রন ও ফলিক এসিডসমৃদ্ধ সবজি ও খাবারের গুরুত্ব
চতুর্থ মাসে আয়রনের ঘাটতি রক্তাল্পতা (অ্যানিমিয়া) সৃষ্টি করে, যা মায়ের ক্লান্তি ও শিশুর বিকাশে বাধা দেয়। এজন্য গাঢ় সবুজ শাকসবজি যেমন পালং শাক, কলমি শাক, লাল শাক, কলিজা, ডাল ও ডিম খাওয়া প্রয়োজন। এছাড়া ফলিক এসিড শিশুর মস্তিষ্ক ও নার্ভ সিস্টেমের সঠিক গঠন নিশ্চিত করে। চিকিৎসকের পরামর্শে ফলিক এসিড ট্যাবলেট নেওয়াও যেতে পারে।
৪. ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবারের ভূমিকা
এই সময় শিশুর হাড় ও দাঁতের গঠন শুরু হয়, তাই ক্যালসিয়াম অপরিহার্য। প্রতিদিন এক গ্লাস দুধ, দই, পনির বা ছোট মাছ খাওয়া উপকারী। ভিটামিন ডি সূর্যালোক থেকে পাওয়া যায়, তাই প্রতিদিন সকালে কিছুক্ষণ রোদে থাকা দরকার। এই দুটি উপাদান মায়ের হাড় মজবুত রাখে এবং শিশুর হাড়ের বিকাশে সহায়তা করে।
৫. ফলমূল ও শাকসবজি প্রতিদিনের খাদ্যে অন্তর্ভুক্ত করা
গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন রঙের ফল ও সবজি খাওয়া অত্যন্ত জরুরি। আপেল, কলা, পেয়ারা, কমলা, ড্রাগনফল, আম ইত্যাদি ফল মায়ের শরীরে প্রাকৃতিক ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সরবরাহ করে। এগুলো হজমে সহায়তা করে, কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। প্রতিদিন অন্তত দুই বেলা ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুললে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য দুটোই ভালো থাকবে।
৬. শর্করা ও শক্তিদায়ক খাবারের সঠিক পরিমাণ বজায় রাখা
শরীরে শক্তি ধরে রাখতে প্রতিদিন ভাত, রুটি, আলু, গম বা ওটস খাওয়া দরকার। তবে অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট খেলে ওজন বেড়ে যেতে পারে, যা গর্ভাবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ। তাই পরিমিত পরিমাণে শর্করা খাওয়া এবং তেলে ভাজা খাবার কমানো উচিত। শক্তিদায়ক এই খাবারগুলো মায়ের দৈনন্দিন কাজের জন্য শক্তি যোগায় এবং শিশুর বৃদ্ধি সহায়তা করে।
৭. পানি ও তরল খাবারের পরিমাণ বাড়ানো
এই সময় পর্যাপ্ত পানি পান না করলে কোষ্ঠকাঠিন্য, ডিহাইড্রেশন ও মূত্রনালীর সংক্রমণ হতে পারে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৮–১০ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিত। পাশাপাশি ফলের রস, দুধ, লাচ্ছি বা স্যুপ খাওয়া যেতে পারে। চা-কফি বা সফট ড্রিঙ্ক এড়িয়ে চলাই ভালো, কারণ এতে ক্যাফেইন শিশুর বিকাশে ক্ষতি করতে পারে।
৮. চতুর্থ মাসে খাবার গ্রহণের সময় ও পরিমাণের ভারসাম্য রাখা
একসঙ্গে বেশি খাওয়ার বদলে দিনে ৫–৬ বার অল্প অল্প করে খাওয়া ভালো। এতে হজম সহজ হয় এবং বমি ভাব কমে। সকালে হালকা খাবার, দুপুরে ভাত-মাছ বা ডাল, বিকেলে ফল বা দই এবং রাতে হালকা খাবার খাওয়া উপযুক্ত। অতিরিক্ত ঝাল, তেলযুক্ত ও রাসায়নিক মিশ্রিত খাবার এড়িয়ে চললে গর্ভাবস্থা অনেক বেশি আরামদায়ক হয়।
৯. পুষ্টিকর স্ন্যাকস যেমন বাদাম, খেজুর ও দইয়ের উপকারিতা
স্ন্যাকস হিসেবে ভাজা বাদাম, কাজুবাদাম, খেজুর বা দই খাওয়া দারুণ উপকারী। এগুলো শরীরে ভালো চর্বি ও শক্তি জোগায়। খেজুর রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ায়, বাদাম মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়তা করে এবং দই হজমে সহায়তা করে। তাই অতিরিক্ত তেলভাজা খাবারের পরিবর্তে এসব স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।
১০. চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্য সম্পূরক (Supplement) গ্রহণ
সবসময় খাবারের মাধ্যমে সব পুষ্টি পাওয়া সম্ভব হয় না। এজন্য চিকিৎসকের পরামর্শে আয়রন, ফলিক এসিড, ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম ও মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট নেওয়া দরকার। তবে এসব ওষুধ কখনই নিজে থেকে খাওয়া উচিত নয়। চিকিৎসক মা ও শিশুর অবস্থা দেখে সঠিক ডোজ নির্ধারণ করবেন। সঠিক সম্পূরক গ্রহণ মা ও শিশুর স্বাস্থ্য দুটোকেই সুরক্ষিত রাখে।
৪ মাসের গর্ভবতী মায়ের কি কি ফল খাওয়া উচিত?

গর্ভাবস্থার চতুর্থ মাসে ফলমূল হলো মায়ের শরীর ও শিশুর বিকাশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই সময়ে শরীরে ভিটামিন, খনিজ ও ফাইবারের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। ফল শুধুমাত্র সেই চাহিদা পূরণ করে না, বরং মায়ের হজমে সহায়তা করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং শিশুর সুস্থ বিকাশ নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সহজলভ্য এমন অনেক ফল আছে যা এই সময়ে গর্ভবতী নারীর জন্য আদর্শ পুষ্টির উৎস হতে পারে।
চতুর্থ মাসে গর্ভবতী মায়ের জন্য আপেল, কমলা, পেয়ারা, কলা, ড্রাগনফল, বেদানা, পেঁপে (হালকা পাকা), আম ও কিউই ফল অত্যন্ত উপকারী। আপেলে থাকে আয়রন ও ফাইবার, যা রক্ত বাড়াতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সাহায্য করে। কমলালেবু ভিটামিন সি-এর চমৎকার উৎস, যা শরীরে আয়রন শোষণ বাড়ায় এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করে।
পেয়ারা হলো বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ফল, এতে ভিটামিন সি, ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। এটি মায়ের দাঁত, হাড় ও ত্বক সুস্থ রাখে এবং শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গঠনে সহায়ক। কলা গর্ভবতী নারীদের জন্য আদর্শ কারণ এতে পটাশিয়াম ও ভিটামিন বি৬ থাকে, যা বমি ভাব কমাতে ও শক্তি জোগাতে সাহায্য করে।
বেদানা রক্তের হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি করে এবং রক্তাল্পতা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ড্রাগনফল দেহে ভিটামিন সি ও ক্যালসিয়াম সরবরাহ করে, যা হাড় ও ত্বকের জন্য উপকারী। আর কিউই ফলের ভিটামিন সি ও ফোলেট শিশুর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সহায়তা করে।
তবে পাকা পেঁপে সামান্য পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে, কিন্তু কাঁচা পেঁপে বা আনারস খাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ এগুলো জরায়ুর সংকোচন বাড়িয়ে গর্ভপাতের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই ফল নির্বাচন করার সময় সবসময় সতর্ক থাকতে হবে এবং ধোয়া, পরিষ্কার ও তাজা ফলই খাওয়া উচিত।
দিনে অন্তত ২–৩ বেলার মাঝে ফল অন্তর্ভুক্ত করা ভালো। সকালে খালি পেটে বা বিকেলের নাস্তার সময় ফল খেলে হজমে সুবিধা হয় এবং শরীর প্রয়োজনীয় ভিটামিন দ্রুত শোষণ করতে পারে। ফলের রসের চেয়ে পুরো ফল খাওয়া বেশি উপকারী, কারণ এতে ফাইবার বেশি থাকে।
এছাড়া অতিরিক্ত মিষ্টি ফল যেমন আম বা লিচু পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে, বিশেষ করে যদি গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থাকে। ফল খাওয়ার পরপরই পানি পান না করে অন্তত ২০ মিনিট অপেক্ষা করা উচিত, এতে হজম ভালো হয়।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ফলমূল হলো গর্ভবতী মায়ের প্রাকৃতিক ও নিরাপদ পুষ্টির উৎস। এটি কেবল মায়ের শরীরকে সতেজ ও রোগমুক্ত রাখে না, বরং শিশুর জন্মের সময় তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি, ওজন ও মস্তিষ্কের বিকাশেও সহায়ক ভূমিকা রাখে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
৪ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
৪ মাসের গর্ভবতী মায়ের দৈনন্দিন খাবার কেমন হওয়া উচিত এবং কোন খাবারগুলো সবচেয়ে উপকারী?
গর্ভাবস্থার ৪র্থ মাসে মায়ের শরীরে শিশুর বৃদ্ধি দ্রুত হয়, তাই প্রতিদিনের খাবার তালিকায় পুষ্টির ভারসাম্য থাকা সবচেয়ে জরুরি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই হালকা কিছু যেমন দুধ, কলা বা খেজুর খাওয়া ভালো। সকালের নাস্তা হতে পারে আটার রুটি, ডিম, দুধ ও সবজি। দুপুরে ভাতের সঙ্গে মাছ, ডাল, শাকসবজি ও সামান্য দই খাওয়া উপযুক্ত। বিকেলে এক কাপ দুধ বা ফল যেমন পেয়ারা, আপেল বা বেদানা খাওয়া যেতে পারে।
রাতে হালকা খাবার যেমন খিচুড়ি, ভাপা সবজি বা স্যুপ খাওয়া হজমে সাহায্য করে এবং ঘুমও ভালো হয়। দিনের মাঝে প্রচুর পানি পান করা ও তরল খাবার যেমন ডাবের পানি বা ফলের রস শরীরকে হাইড্রেট রাখে।
সবচেয়ে উপকারী খাবারের মধ্যে আছে মাছ, ডিম, মুরগি, দুধ, দই, শাকসবজি ও ফলমূল। এগুলো প্রোটিন, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফলিক এসিড ও ভিটামিনে সমৃদ্ধ, যা শিশুর হাড়, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর বিকাশে অপরিহার্য।
৪ মাসের গর্ভবতী মায়ের জন্য কোন ফলগুলো সবচেয়ে উপকারী এবং কোন ফলগুলো খাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে?
গর্ভাবস্থার ৪র্থ মাসে ফলমূল হলো প্রাকৃতিক পুষ্টির সেরা উৎস। আপেল, পেয়ারা, কমলা, বেদানা, কলা, ড্রাগনফল ও কিউই ফল এই সময়ে খাওয়া অত্যন্ত উপকারী। আপেলে রয়েছে ফাইবার ও আয়রন, যা কোষ্ঠকাঠিন্য কমায় এবং রক্ত বাড়াতে সাহায্য করে। পেয়ারা ও কমলালেবুতে প্রচুর ভিটামিন সি আছে, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং আয়রন শোষণে সহায়ক।
বেদানা হিমোগ্লোবিন বাড়ায় ও রক্তাল্পতা প্রতিরোধ করে, আর ড্রাগনফল মায়ের হজম শক্তি উন্নত করে। কলা শক্তি জোগায়, পটাশিয়াম সরবরাহ করে এবং বমি ভাব কমাতে সাহায্য করে।
তবে কিছু ফল আছে যা গর্ভাবস্থায় একেবারেই খাওয়া উচিত নয়। যেমন কাঁচা পেঁপে ও আনারস — এদের মধ্যে এমন কিছু প্রাকৃতিক এনজাইম থাকে যা জরায়ুর সংকোচন ঘটাতে পারে এবং গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া অতিরিক্ত মিষ্টি ফল যেমন লিচু বা আম পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে, বিশেষ করে যদি গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থাকে।
উপসংহার
গর্ভাবস্থার চতুর্থ মাস হলো এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়, যখন মা ও শিশুর উভয়ের শরীরে দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। এই সময়েই শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, হাড়, স্নায়ুতন্ত্র এবং মস্তিষ্কের বিকাশ শুরু হয়। তাই মায়ের খাদ্যাভ্যাস, বিশ্রাম ও মানসিক প্রশান্তি— সবকিছুই ভবিষ্যৎ সন্তানের স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
এই পর্যায়ে গর্ভবতী মায়ের খাদ্যতালিকা শুধু পেট ভরানোর বিষয় নয়, বরং এটি পুষ্টির এক বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা। প্রতিদিনের খাবারে প্রোটিন, আয়রন, ফলিক এসিড, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি, বি ও সি—এই উপাদানগুলো সঠিক ভারসাম্যে থাকা প্রয়োজন। মুরগি, মাছ, ডিম, ডাল, শাকসবজি, দুধ, ফলমূল, বাদাম ও পূর্ণ শস্য একত্রে একটি পূর্ণাঙ্গ খাদ্যতালিকা গঠন করে।
বাংলাদেশের মাটিতে সহজলভ্য এসব খাবার যেমন পুষ্টিকর, তেমনি সাশ্রয়ীও। গৃহিণীরা চাইলে স্থানীয় বাজারের উপকরণ দিয়েই একটি স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পরিকল্পনা করতে পারেন। যেমন সকালে গরম দুধের সঙ্গে খেজুর, দুপুরে ভাত-ডাল-সবজি, বিকেলে পেয়ারা বা কলা, রাতে হালকা খিচুড়ি বা স্যুপ—এই ধরনের সহজ খাবারই গর্ভবতী মায়ের জন্য যথেষ্ট শক্তি ও পুষ্টি সরবরাহ করে।
গর্ভাবস্থার এই সময়ে বিশুদ্ধ পানি পান করা, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া, হালকা হাঁটা এবং মানসিক শান্তি বজায় রাখা খুব জরুরি। কারণ স্ট্রেস বা উদ্বেগ হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে, যা শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত করে। তাই মনের প্রশান্তি বজায় রাখার জন্য প্রিয়জনদের সহায়তা, বই পড়া, নামাজ বা ধ্যান করা ভালো ফল দেয়।
চিকিৎসকের নিয়মিত পরামর্শ নেওয়া ও নির্ধারিত সময়ে চেকআপ করানো অপরিহার্য। অনেক মা ভুলবশত অতিরিক্ত খাবার খেয়ে ওজন বাড়িয়ে ফেলেন, আবার কেউ কেউ ওজন না বাড়ায় চিন্তিত হয়ে পড়েন। মনে রাখতে হবে—গর্ভাবস্থায় খাবারের পরিমাণের চেয়ে গুণমান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আরেকটি বিষয় হলো, অনেকে “গর্ভবতী মানেই দুইজনের খাবার খাওয়া” এই ধারণায় প্রতিদিন বেশি পরিমাণে তেল, ভাজাভুজি বা মিষ্টি খাবার খান। এটি আসলে ক্ষতিকর। এতে হজমের সমস্যা, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই সবসময় পরিমিত, ঘরোয়া, সেদ্ধ বা ভাপা খাবারই সর্বোত্তম বিকল্প।
চতুর্থ মাসে ফলমূলের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাজা ফল যেমন আপেল, কমলা, পেয়ারা, বেদানা, কলা ও ড্রাগনফল শুধু শরীরের পুষ্টি জোগায় না, বরং শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে এবং মায়ের ক্লান্তি কমায়। তবে কাঁচা পেঁপে, আনারস বা আধা-পাকা ফল খাওয়া একেবারেই উচিত নয়, কারণ এগুলো জরায়ুতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
সঠিক খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি প্রতিদিন অল্প হাঁটাচলা ও পর্যাপ্ত ঘুমও গর্ভবতী মায়ের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। দিনে অন্তত ৮ ঘণ্টা ঘুম এবং বিকেলে সামান্য বিশ্রাম শরীরকে সতেজ রাখে ও রক্ত সঞ্চালন ভালো করে।
সবশেষে বলা যায়, গর্ভাবস্থার ৪র্থ মাস মানেই হলো নতুন জীবনের ভিত্তি গঠনের সময়। এই সময় যত্ন, সচেতনতা ও পুষ্টির প্রতি মনোযোগই নিশ্চিত করবে একটি সুস্থ, সবল ও মেধাবী শিশুর জন্ম। মা যদি নিজের শরীরের যত্ন নেন, সঠিক খাবার গ্রহণ করেন এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলেন, তাহলে গর্ভকাল হবে আনন্দময় ও নিরাপদ।
