Beriberi disease1

বেরিবেরি রোগ কিসের অভাবে হয়?

বাংলাদেশে এখনো অনেক মানুষ এমন কিছু পুষ্টিহীনতার সমস্যায় ভোগেন যেগুলো মূলত সচেতনতার অভাব এবং খাদ্যাভ্যাসের কারণে ঘটে। এর মধ্যে অন্যতম একটি রোগ হলো বেরিবেরি। এই রোগটি আমাদের দেশের গ্রামীণ এলাকা থেকে শুরু করে শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যেও দেখা যায়। বিশেষ করে যারা নিয়মিতভাবে polished চাল বা অতিরিক্ত পরিশোধিত খাবার খান, তাদের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি অনেক বেশি। বেরিবেরি রোগ মূলত শরীরে ভিটামিন বি১ (থায়ামিন)-এর ঘাটতির কারণে হয়। থায়ামিন আমাদের শরীরে শক্তি উৎপাদন, স্নায়ুর সঠিক কার্যক্রম এবং হজম প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশে অনেকেই এখনো ধারণা রাখেন না, সাধারণ চাল, গম বা ডাল খাওয়ার পদ্ধতিতেই কীভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিনটি নষ্ট হয়ে যায়। অনেক সময় দীর্ঘদিন ভাত ধুয়ে, ঝরঝরে করে রান্না করার কারণে ভিটামিন বি১ ধুয়ে যায়। ফলে শরীরে ধীরে ধীরে এই ভিটামিনের ঘাটতি তৈরি হয় এবং তার ফলেই দেখা দেয় বেরিবেরি রোগ।

এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত অতিরিক্ত দুর্বলতা, অবসাদ, হাত-পায়ে ঝিনঝিন ভাব, বুক ধড়ফড় করা এবং হাঁটতে অসুবিধার মতো উপসর্গ অনুভব করেন। অনেক ক্ষেত্রে এটি স্নায়ুর দুর্বলতা বা হৃদযন্ত্রের জটিলতায় রূপ নেয়। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়, কারণ তাদের শরীরের ভিটামিন চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে।

আমাদের দেশে আজও অনেক পরিবার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় মাছ, ডিম, ডাল, শাকসবজি বা দুধের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাবার বাদ দিয়ে একঘেয়ে চাল-ভিত্তিক খাবারের উপর নির্ভর করে থাকে। এই অভ্যাস ধীরে ধীরে শরীরকে ভিটামিনের ঘাটতিতে ঠেলে দেয়।

বেরিবেরি রোগ নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা খুবই জরুরি, কারণ এটি এমন একটি রোগ যা সময়মতো সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশে পুষ্টি সচেতনতা বাড়ানো এবং গ্রামীণ জনপদে স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচি জোরদার করার মাধ্যমে আমরা সহজেই এই রোগ থেকে মুক্তি পেতে পারি।

এই লেখায় আমরা বিস্তারিতভাবে জানব — বেরিবেরি রোগ কী, কেন হয়, এর কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে। পাশাপাশি আমরা দেখব কীভাবে সাধারণ খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের মাধ্যমে এই রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

বেরিবেরি রোগ কি?

Beriberi disease2

বেরিবেরি হলো এমন একটি পুষ্টিজনিত রোগ, যা শরীরে ভিটামিন বি১ বা থায়ামিনের অভাবের কারণে ঘটে। এই ভিটামিনটি আমাদের শরীরের কোষগুলোকে শক্তি উৎপাদনে সহায়তা করে এবং স্নায়ুতন্ত্র, হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ঠিক রাখে। যখন শরীরে পর্যাপ্ত থায়ামিন থাকে না, তখন কোষগুলো তাদের প্রয়োজনীয় শক্তি পায় না। ফলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দেখা দেয় নানা শারীরিক জটিলতা — সেটিই হলো বেরিবেরি রোগ।

বাংলাদেশের মতো চালভিত্তিক খাদ্যাভ্যাসের দেশে এই রোগ এখনো একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। polished বা ছাঁটা চাল খাওয়ার ফলে থায়ামিন সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। অনেকে আবার দীর্ঘ সময় ধরে একঘেয়ে খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করেন — ভাত, আলু, সামান্য তরকারি; এতে শরীরে প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলের ঘাটতি দেখা দেয়। সময়ের সাথে সাথে এই ঘাটতি বেরিবেরি রোগে রূপ নেয়।

বেরিবেরি রোগের মূলত দুটি প্রধান ধরণ রয়েছে —
১. শুষ্ক বেরিবেরি (Dry Beriberi) এবং
২. ভেজা বেরিবেরি (Wet Beriberi)

শুষ্ক বেরিবেরি মূলত স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব ফেলে। এতে হাত-পা ঝিনঝিন করা, চলাফেরায় সমস্যা, মাংসপেশির দুর্বলতা এবং হাঁটতে কষ্ট হয়। অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তি ঠিকমতো ভারসাম্য রাখতে পারেন না। এটি ধীরে ধীরে স্নায়ু ক্ষয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

অন্যদিকে, ভেজা বেরিবেরি হৃদযন্ত্র ও রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলে। এতে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, পায়ের পাতা ফুলে যায়, শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, এমনকি হৃদযন্ত্রের ব্যর্থতাও হতে পারে। অনেক সময় রোগী হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং হৃদরোগের মতো জটিলতায় ভোগে।

বিশেষ করে নবজাতক ও স্তন্যদানকারী মায়েদের মধ্যে বেরিবেরির ঝুঁকি বেশি থাকে, কারণ থায়ামিনের চাহিদা এই সময় বেশি হয়। শিশুরা যদি মায়ের দুধে পর্যাপ্ত থায়ামিন না পায়, তবে তারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হতে পারে, এমনকি জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

বেরিবেরি রোগের শুরুটা সাধারণত ধীরে ধীরে হয়। প্রথম দিকে মানুষ ক্লান্তি, মনোযোগের ঘাটতি, খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া বা হালকা ঝিমঝিম ভাব অনুভব করে। সময়মতো চিকিৎসা না পেলে এই সাধারণ লক্ষণগুলো মারাত্মক অবস্থায় পরিণত হয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো — বেরিবেরি কোনো সংক্রামক রোগ নয়। এটি শুধু পুষ্টিহীনতার ফলাফল। তাই সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পরিমাণমতো শর্করা, ডাল, ডিম, মাছ, দুধ, বাদাম ও শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুললে এই রোগ সহজেই প্রতিরোধ করা যায়।

বেরিবেরি রোগ কিসের অভাবে হয়?

Beriberi disease3

বেরিবেরি রোগ মূলত শরীরে ভিটামিন বি১ (থায়ামিন)-এর ঘাটতির কারণে হয়। এটি একটি পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন, যা শরীরে শক্তি উৎপাদন ও স্নায়ুতন্ত্রের কাজের জন্য অপরিহার্য। যখন খাদ্যাভ্যাসে থায়ামিনের অভাব দেখা দেয় বা শরীর তা শোষণ করতে পারে না, তখন ধীরে ধীরে কোষগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়। এই অবস্থার ফলেই সৃষ্টি হয় বেরিবেরি রোগ।

নিচে বেরিবেরি রোগের জন্য দায়ী ১০টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বা ঘাটতির উৎস বিস্তারিতভাবে উপশিরোনাম আকারে দেওয়া হলো —

১. অতিরিক্ত পরিশোধিত (Polished) চাল খাওয়ার ফলে থায়ামিনের ঘাটতি বৃদ্ধি

বাংলাদেশে দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় চালের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি। বিশেষ করে শহরের বাজারে পাওয়া চটপটে, সাদা ও অতিরিক্ত পরিশোধিত চাল খাদ্যাভ্যাসের মূল অংশ। এই ধরনের চালে ভিটামিন বি১ বা থায়ামিন প্রাকৃতিকভাবে অনেক কম থাকে। কারণ চালের শর্করা পূর্ণ থাকলেও খোসা ও ভুট্টার অংশ বাদ দেওয়া হয়, যেখানে ভিটামিন বি১ সবচেয়ে বেশি থাকে।

যখন মানুষ নিয়মিতভাবে এই পরিশোধিত চাল খায়, শরীরে পর্যাপ্ত থায়ামিনের সরবরাহ হয় না। থায়ামিনের অভাবে শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। ফলস্বরূপ, কোষগুলো প্রয়োজনীয় শক্তি পাচ্ছে না। হাত-পা দুর্বল হয়ে যায়, হাঁটাচলায় অসুবিধা দেখা দেয় এবং অনেক সময় মনোযোগের ঘাটতি দেখা দেয়।

গ্রামীণ এলাকায় অনেক পরিবার ধীরে ধীরে এই রোগে আক্রান্ত হন, কারণ তারা মূলত শুধুমাত্র ভাতের উপর নির্ভর করেন এবং অন্যান্য থায়ামিন সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন ডাল, বাদাম, শাকসবজি বা মাছ কম খান। এ ছাড়া, ভাত রান্নার সময় অতিরিক্ত ধুয়ে বা দীর্ঘক্ষণ রান্না করলে ভিটামিনের পরিমাণ আরও কমে যায়।

বেশিরভাগ শিশু ও বৃদ্ধের মধ্যে এই অভ্যাস সবচেয়ে ক্ষতিকর। শিশুদের শরীরের থায়ামিনের চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেশি। যদি তাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পরিশোধিত চালই প্রধান থাকে, তবে তারা দ্রুত দুর্বল হয়ে যায়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই ঘাটতি হৃদরোগ ও স্নায়ুজটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়।

শহরে চটপটে সাদা চাল ব্যবহার করার ফলে রোগীর মধ্যে শারীরিক দুর্বলতা, অনিদ্রা, হাত-পা ঝিনঝিন করা এবং হঠাৎ ক্লান্তি দেখা দেয়। দীর্ঘমেয়াদি অভ্যাসে এটি শুষ্ক বা ভেজা বেরিবেরিতে রূপ নিতে পারে।

বাংলাদেশে খাদ্য সচেতনতা না থাকায় অনেক পরিবার এই সমস্যার কারণ চিহ্নিত করতে পারেন না। তারা শুধু ক্লান্তি বা দুর্বলতাকে দৈনন্দিন জীবনের অংশ মনে করেন। অথচ মূল সমস্যা হলো খাদ্যাভ্যাস।

পরিশোধিত চালের বদলে যদি আখি চাল, brown rice বা অন্যান্য কম প্রক্রিয়াজাত চাল ব্যবহার করা হয়, থায়ামিনের ঘাটতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এছাড়া ডাল, বাদাম, তিল, মাছ ও দুধের মতো ভিটামিন বি১ সমৃদ্ধ খাবার নিয়মিত খাওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।

শিশুদের খাদ্য তালিকায় রুটি, ডাল, সবজি ও ছোট পরিমাণ বাদাম বা মাছ অন্তর্ভুক্ত করলে থায়ামিনের ঘাটতি প্রতিরোধ করা সম্ভব। একইভাবে, বয়স্কদেরও দৈনন্দিন খাদ্যে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের মাধ্যমে এই রোগ থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়।

অতিরিক্ত পরিশোধিত চাল খাওয়া শুধুমাত্র থায়ামিনের ঘাটতি তৈরি করে না, বরং শরীরের অন্যান্য ভিটামিন ও খনিজের মাত্রাকেও কমিয়ে দেয়। এই কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয় এবং সহজে বিভিন্ন সংক্রমণ ও শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।

২. একঘেয়ে খাদ্যাভ্যাস ও শাকসবজি-বর্জিত ডায়েটের কারণে ভিটামিনের অভাব

বাংলাদেশে অনেক পরিবার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় ভাত ও আলুর উপর অত্যাধিক নির্ভরশীল। মাংস, ডাল বা শাকসবজি খাওয়ার পরিমাণ খুবই সীমিত থাকে। এই ধরনের একঘেয়ে খাদ্যাভ্যাস শরীরে থায়ামিনসহ অন্যান্য ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতি তৈরি করে। দীর্ঘদিন ধরে এই অভ্যাস বজায় থাকলে শরীরের পুষ্টি ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং বেরিবেরি রোগসহ অন্যান্য পুষ্টিজনিত সমস্যা দেখা দেয়।

আরোও পড়ুনঃ  আপেল সিডার ভিনেগার এর উপকারিতা সমূহ

শাকসবজি ভিটামিন বি১-এর গুরুত্বপূর্ণ উৎস। তিল, বাদাম, ডাল এবং সবুজ শাকের মতো খাবার নিয়মিত না খেলে থায়ামিনের ঘাটতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে এই অভ্যাস মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কারণ তাদের শরীরের দ্রুত বৃদ্ধি ও শক্তি উৎপাদনের জন্য বেশি পুষ্টি প্রয়োজন।

শহরের ব্যস্ত জীবনধারার কারণে অনেক পরিবার রান্নার সময় শাকসবজি বাদ দেন। দোকান থেকে রেডিমেড বা ফাস্ট ফুড গ্রহণের অভ্যাসও এই ঘাটতি বাড়িয়ে দেয়। ফলে শরীর প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ পাচ্ছে না, যা ধীরে ধীরে হাত-পা দুর্বলতা, ক্লান্তি, মনোযোগের ঘাটতি এবং খাবারের প্রতি অনিচ্ছা হিসেবে প্রকাশ পায়।

গ্রামীণ এলাকায় যদিও খাদ্যাভ্যাস তুলনামূলকভাবে সহজ, তবুও একঘেয়ে খাবার যেমন শুধুমাত্র ভাত, আলু ও শুকনো মাছ বা ডাল খাওয়া রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এখানে স্থানীয় শাক, তেল, বাদাম এবং বিভিন্ন ফলের ব্যবহার কম। দীর্ঘমেয়াদি অভ্যাসে এই ধরনের ঘাটতি বেরিবেরি রোগের দিকে পরিচালিত করে।

গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের ক্ষেত্রে একঘেয়ে খাদ্যাভ্যাস আরও ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের শরীরের থায়ামিনের চাহিদা বেশি থাকে। যদি এই চাহিদা পূরণ না হয়, তবে মা ও শিশুর উভয়ের মধ্যে পুষ্টি ঘাটতি দেখা দেয়। শিশুরা দুর্বল হয়ে পড়ে, বৃদ্ধির ধরণ নষ্ট হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

শহর ও গ্রামে প্রচলিত রান্নার ধরণ যেমন সবজি হালকা সিদ্ধ করা বা সরাসরি বাদ দিয়ে রান্না করা, এই অভ্যাসও থায়ামিন হ্রাস করে। শাকসবজি না খাওয়া শুধু থায়ামিনের ঘাটতি তৈরি করে না, বরং ভিটামিন বি২, বি৬, সি এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদানকেও কমিয়ে দেয়।

এই অভ্যাস থেকে বের হওয়ার জন্য পরিবারকে খাদ্য তালিকায় কমপক্ষে দুই প্রকার শাক, মাছ, ডাল, বাদাম এবং মৌসুমি ফল অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিশুদের মধ্যে ছোট ছোট অংশে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো উচিত। একইভাবে, বয়স্ক ও গর্ভবতী মহিলাদেরও প্রতিদিনের খাবারে শাক-সবজি ও প্রোটিনের যথেষ্ট যোগ নিশ্চিত করতে হবে।

একঘেয়ে খাদ্যাভ্যাস ধীরে ধীরে শারীরিক দুর্বলতা, হাঁটাচলায় অসুবিধা, স্নায়ুর সমস্যা এবং হৃদরোগজনিত ঝুঁকি তৈরি করে। তাই খাদ্য বৈচিত্র্য বজায় রাখা, স্থানীয় শাকসবজি, ডাল, বাদাম ও মাছের ব্যবহার বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি।

৩. দীর্ঘমেয়াদি অ্যালকোহল গ্রহণে শরীরে থায়ামিন শোষণ ব্যাহত হওয়া

দীর্ঘদিন ধরে অ্যালকোহল গ্রহণ শরীরের জন্য অনেক ধরনের ক্ষতির কারণ হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো থায়ামিন শোষণে বাধা সৃষ্টি। অ্যালকোহল কেবল জিহ্বা বা মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে না, এটি অন্ত্রে থায়ামিন শোষণ প্রক্রিয়াতেও সমস্যা তৈরি করে। ফলে শরীর পর্যাপ্ত ভিটামিন বি১ পায় না, যা ধীরে ধীরে বেরিবেরি রোগের দিকে নিয়ে যায়।

বাংলাদেশে যদিও অ্যালকোহল সেবন অনেক ক্ষেত্রে কম, তবে যেসব মানুষের মধ্যে নিয়মিত মদ্যপান আছে, তাদের মধ্যে এই ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘমেয়াদি অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে পেটে থাকা অন্ত্রের সেলগুলো থায়ামিন শোষণ করতে সক্ষম হয় না। শরীরের থায়ামিনের ঘাটতি ধীরে ধীরে স্নায়ু ও হৃদযন্ত্রে প্রভাব ফেলে।

অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে থায়ামিন মেটাবোলিজমেও সমস্যা দেখা দেয়। যেহেতু থায়ামিন শক্তি উৎপাদন ও কোষের কার্যক্রমে অপরিহার্য, তাই এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে রোগীর মধ্যে হাত-পা দুর্বলতা, মনোযোগের অভাব, ক্লান্তি এবং চলাফেরায় সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়ে।

সাধারণত যারা দীর্ঘদিন ধরে মদ্যপান করেন, তারা খাদ্যাভ্যাসেও অনিয়ম করেন। অনেক সময় তারা পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে পারেন না, যেমন শাক, ডাল, মাছ বা বাদাম। এতে থায়ামিনের ঘাটতি আরও বাড়ে এবং রোগ ধীরে ধীরে প্রকট হয়।

শিশু বা গর্ভবতী মা নয়, তবে বড়দের ক্ষেত্রে অ্যালকোহল জনিত এই ঘাটতি হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, পেশি দুর্বলতা এবং মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘমেয়াদি অবস্থায় রোগীকে ভেজা বেরিবেরি বা শুষ্ক বেরিবেরি উভয়ই আক্রান্ত করতে পারে।

অ্যালকোহল গ্রহণ ছাড়াই নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করলে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। ভিটামিন বি১ সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন ডাল, বাদাম, শাকসবজি, মাছ ও দুধ নিয়মিত খেলে শরীর থায়ামিনের ঘাটতি পূরণ করতে পারে।

শহরে অ্যালকোহল গ্রহণ সীমিত হলেও, যারা অনিয়মিত বা অতিরিক্ত পান করেন, তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য খাওয়ার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। কারণ অ্যালকোহল শুধু থায়ামিন কমায় না, বরং শরীরের অন্যান্য পুষ্টি উপাদানও হ্রাস করে।

৪. হজমজনিত সমস্যা বা অন্ত্রের রোগে থায়ামিন শোষণ কমে যাওয়া

শরীরের পুষ্টি শোষণের ক্ষমতা অনেকাংশে অন্ত্রের স্বাস্থ্য নির্ভর করে। হজমজনিত সমস্যা যেমন দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া, ক্রোন রোগ, সেলিয়াক ডিজিজ বা অন্যান্য অন্ত্র সংক্রান্ত রোগে থায়ামিন শোষণ বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে শরীর পর্যাপ্ত ভিটামিন বি১ পায় না এবং বেরিবেরি রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশে অনেক শিশু ও বয়স্কের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি হজমজনিত সমস্যা দেখা দেয়। যারা নিয়মিত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খান না, তাদের ক্ষেত্রে থায়ামিন ঘাটতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ডায়রিয়া বা দীর্ঘমেয়াদি অন্ত্রের প্রদাহের কারণে খাবার থেকে পুষ্টি শোষণ ঠিকভাবে হয় না।

শিশুদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা মারাত্মক। নিয়মিত ডায়রিয়া থাকলে শরীরের পুষ্টি হার অনেক দ্রুত হয়। তাদের মধ্যে হাত-পা দুর্বলতা, হাঁটাচলায় অসুবিধা, ক্লান্তি, অনিদ্রা এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতার কমে যাওয়া দেখা দেয়। একইভাবে, বয়স্কদের মধ্যে এই সমস্যা হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা এবং স্নায়ু সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি করে।

এছাড়া, অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হলে থায়ামিনের শোষণ আরও কমে যায়। অ্যালকোহল, ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ বা দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া এই ভারসাম্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে রোগীর শরীরে থায়ামিনের অভাব দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মহিলাদেরও এই ঝুঁকি বেশি। অন্ত্রের রোগের কারণে তারা পর্যাপ্ত ভিটামিন শোষণ করতে পারলে শিশুর বৃদ্ধি ও মায়ের স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়ে। শিশুদের মধ্যে এটি বেরিবেরি ও অন্যান্য পুষ্টি ঘাটতির কারণ হতে পারে।

শহরে কিংবা গ্রামে দীর্ঘমেয়াদি হজমজনিত সমস্যার কারণে থায়ামিন ঘাটতি কমানো সম্ভব, যদি রোগী নিয়মিত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করেন। ডাল, বাদাম, মাছ, শাকসবজি ও ভিটামিন সমৃদ্ধ অন্যান্য খাবার থায়ামিন সরবরাহে সহায়ক।

বহু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হজমজনিত সমস্যার চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। অন্ত্রের স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে শরীরের পুষ্টি শোষণ স্বাভাবিক হয় এবং বেরিবেরি রোগ প্রতিরোধ করা যায়।

৫. গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের শরীরে অতিরিক্ত চাহিদা পূরণ না হওয়া

গর্ভবতী এবং স্তন্যদানকারী মহিলাদের শরীরে ভিটামিন বি১ বা থায়ামিনের চাহিদা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। শিশু জন্মদানের সময় মা ও শিশুর শরীরের জন্য অতিরিক্ত শক্তি এবং পুষ্টি প্রয়োজন হয়। যদি খাদ্যতালিকায় যথেষ্ট থায়ামিন না থাকে, তাহলে মা ও শিশুর উভয়ের শরীরে ঘাটতি তৈরি হয় এবং বেরিবেরি রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশে অনেক গর্ভবতী মা পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের পরিবর্তে ভাত ও আলুর উপর নির্ভর করেন। এছাড়া মাছ, ডাল, বাদাম, শাকসবজি বা দুধের পর্যাপ্ত গ্রহণ না হলে শরীরে থায়ামিনের অভাব ধীরে ধীরে তৈরি হয়। ফলস্বরূপ, মা ক্লান্তি, দুর্বলতা, হাঁটাচলায় অসুবিধা এবং মনোযোগ কমে যাওয়া অনুভব করেন।

শিশুর জন্যও এই ঘাটতি মারাত্মক প্রভাব ফেলে। মাতৃদূধে পর্যাপ্ত থায়ামিন না থাকলে শিশু দ্রুত দুর্বল হয়ে যায়। তাদের মধ্যে হাত-পা দুর্বলতা, হাঁটাচলায় সমস্যা, মনোযোগ কমে যাওয়া এবং বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হওয়া দেখা দেয়। বিশেষ করে নবজাতক এবং ১–২ বছরের শিশুদের মধ্যে এটি মারাত্মক হতে পারে।

ব্রেন ও স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশও থায়ামিনের ওপর নির্ভরশীল। গর্ভকালীন পর্যায়ে ঘাটতি থাকলে শিশুর স্নায়ু ও মস্তিষ্কের বিকাশে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়া মা ও শিশুর মধ্যে এনার্জি উৎপাদনও ব্যাহত হয়।

আরোও পড়ুনঃ  যক্ষা রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ সমূহ

শহর ও গ্রামীণ উভয় এলাকায় এই ঝুঁকি দেখা দেয়। গ্রামীণ এলাকায় যদিও শাকসবজি ও ডালের ব্যবহার কিছুটা বেশি থাকে, তবুও অনেক মা একঘেয়ে খাদ্য গ্রহণ করেন। শহরে ফাস্ট ফুড, হালকা খাদ্য ও কম পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের কারণে ঘাটতি আরও প্রকট হয়।

মায়ের থায়ামিনের ঘাটতি শুধুমাত্র দুর্বলতা ও ক্লান্তি সৃষ্টি করে না, বরং হৃদযন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্ষমতাকেও প্রভাবিত করে। এতে মা সহজে শারীরিক অসুস্থতায় ভোগেন এবং শিশুরও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

সমাধান হলো গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের খাদ্য তালিকায় ডাল, বাদাম, শাকসবজি, মাছ, দুধ এবং হালকা বাদাম জাতীয় স্ন্যাক্স অন্তর্ভুক্ত করা। নিয়মিত এই খাদ্য গ্রহণ থায়ামিনের ঘাটতি পূরণে সহায়তা করে এবং বেরিবেরি রোগ প্রতিরোধ করে।

৬. দীর্ঘদিন ডায়রিয়া, বমি বা পুষ্টিহীনতায় ভিটামিন ক্ষয় হয়ে যাওয়া

দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া বা বারবার বমি হওয়া শরীরের পুষ্টি শোষণ প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে। যখন খাবার শরীরের কোষে পৌঁছার আগে হজম হয় না বা বের হয়ে যায়, তখন ভিটামিন বি১ বা থায়ামিন যথেষ্ট শোষিত হয় না। ফলে শরীরে ঘাটতি তৈরি হয়, যা ধীরে ধীরে বেরিবেরি রোগের দিকে পরিচালিত করে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ ও অর্ধ-শহুরে এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া একটি সাধারণ সমস্যা। শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে এটি মারাত্মক প্রভাব ফেলে। শিশুদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, মনোযোগ কমে যায় এবং হাঁটাচলায় সমস্যা দেখা দেয়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে দুর্বলতা, ক্লান্তি ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা তৈরি হয়।

পুষ্টিহীনতা বা খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্যের অভাবও এই ঘাটতিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ভাত ও আলু নির্ভর খাদ্য তালিকা, ডাল বা শাক কম খাওয়া, দুধ বা মাছের অভাব — সব মিলিয়ে থায়ামিনের ঘাটতি তৈরি হয়। দীর্ঘদিন এই অভ্যাস বজায় থাকলে ঘাটতি মারাত্মক রূপ নেয়।

ডায়রিয়া বা বমির কারণে শরীরের জলীয় ভারসাম্যও বিঘ্নিত হয়। এসময় শরীরের পুষ্টি হার আরও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ফলে রোগীর মধ্যে হাত-পা দুর্বলতা, স্নায়ুর দুর্বলতা, ক্লান্তি, অস্বাভাবিক দৃষ্টি সমস্যা এবং হঠাৎ দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।

শিশুদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। ডায়রিয়ার কারণে শিশু প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে না, ফলে শক্তি উৎপাদন ব্যাহত হয়। গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রেও এ সমস্যা গুরুতর। পুষ্টি ঘাটতি মা ও শিশুর উভয়ের স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে।

শহর ও গ্রামে খাদ্যাভ্যাসের অভাব ও ডায়রিয়া সমস্যার সমন্বয় বেরিবেরি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। অনেক সময় পরিবার বুঝতে পারে না যে দীর্ঘমেয়াদি দুর্বলতা, ক্লান্তি বা হাঁটাচলায় অসুবিধার কারণ মূলত পুষ্টির ঘাটতি।

সমাধান হলো ডায়রিয়া বা বমি সমস্যা দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ নিশ্চিত করা। ডাল, শাকসবজি, মাছ, বাদাম, দুধ এবং ছোট ছোট ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবারের মাধ্যমে থায়ামিনের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।

৭. দীর্ঘ সময় ধরে সাদা ভাত, আলু ও চিনি নির্ভর খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস

বাংলাদেশে অনেক পরিবারের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় প্রধানত সাদা ভাত ও আলুর উপর নির্ভরশীলতা অত্যন্ত বেশি। সকালে, দুপুরে ও রাতে প্রায় সকল খাবার এই দু’টি উপাদানের উপর ভিত্তি করে সাজানো থাকে। এছাড়া অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি খাবারের ব্যবহারও সাধারণ। এই ধরনের একঘেয়ে খাদ্যাভ্যাস শরীরে ভিটামিন বি১ বা থায়ামিনের ঘাটতি তৈরি করে।

সাদা ভাতের প্রক্রিয়াজাতকরণের কারণে এর ভুট্টা ও খোসা অংশ বাদ দেওয়া হয়, যেখানে ভিটামিন বি১ ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ থাকে। ফলে সাদা ভাত খেলে শরীর পর্যাপ্ত থায়ামিন পায় না। আলু ও চিনি মূলত কার্বোহাইড্রেটের উৎস, কিন্তু থায়ামিন সরবরাহে তা অপ্রতুল। দীর্ঘদিন এই অভ্যাস বজায় থাকলে ধীরে ধীরে কোষের শক্তি উৎপাদন ব্যাহত হয়।

শিশু ও কিশোরদের ক্ষেত্রে এই অভ্যাস সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের দ্রুত বৃদ্ধি এবং শক্তি উৎপাদনের জন্য থায়ামিনের প্রয়োজন বেশি। সাদা ভাত ও আলুর একঘেয়ে ডায়েটের কারণে শিশুদের মধ্যে ক্লান্তি, মনোযোগের অভাব, হাঁটাচলায় দুর্বলতা এবং স্নায়ুর সমস্যা দেখা দিতে পারে।

বয়স্কদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি এই অভ্যাস হৃদযন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রোগীর মধ্যে হাত-পা দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, হঠাৎ দুর্বলতা এবং হাঁটাচলায় সমস্যা দেখা দিতে পারে। যদি যথাসময়ে খাদ্য পরিবর্তন বা পুষ্টি সম্পূরক গ্রহণ না করা হয়, তবে শুষ্ক বা ভেজা বেরিবেরি ধীরে ধীরে প্রকট হয়।

শহরে ফাস্ট ফুড, সাদা রুটির খাবার ও মিষ্টি পানীয়ের কারণে এই অভ্যাস আরও বৃদ্ধি পায়। পরিবারের সচেতনতা না থাকায় অনেকেই বুঝতে পারেন না যে শুধু ক্লান্তি বা দুর্বলতাই মূল সমস্যা নয়, বরং এটি পুষ্টিহীনতার সরাসরি ফল।

সমাধান হলো খাদ্য তালিকায় কমপক্ষে দুই প্রকার শাক, ডাল, বাদাম, মাছ, দুধ এবং ফল অন্তর্ভুক্ত করা। এছাড়া সাদা ভাতের পরিবর্তে আখি চাল বা ব্রাউন রাইস ব্যবহার থায়ামিন সরবরাহে সহায়ক। শিশুদের জন্য ছোট অংশে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো উচিত।

দীর্ঘ সময় সাদা ভাত, আলু ও চিনি নির্ভর খাদ্য গ্রহণ শুধু থায়ামিনের ঘাটতি তৈরি করে না, বরং শরীরের অন্যান্য ভিটামিন ও খনিজের মাত্রাকেও হ্রাস করে। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয় এবং সহজে সংক্রমণ ও শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।

৮. অতিরিক্ত চা, কফি বা পানীয় গ্রহণে থায়ামিন ভাঙনের প্রবণতা বৃদ্ধি

বাংলাদেশে চা একটি দৈনন্দিন পানীয় হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। সকালে, দুপুরে বা সন্ধ্যায় প্রায় সকল পরিবার চা পান করেন। শহরে কফি গ্রহণের অভ্যাসও দিনদিন বাড়ছে। তবে অতিরিক্ত চা বা কফি, বিশেষ করে খালি পেটে, শরীরের ভিটামিন বি১ বা থায়ামিনকে নষ্ট করতে পারে। ফলে শরীরে ঘাটতি তৈরি হয়, যা ধীরে ধীরে বেরিবেরি রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

চা ও কফিতে থাকা কফিন এবং কিছু অ্যান্টিনিউট্রিয়েন্ট উপাদান থায়ামিনকে অকার্যকর করে দেয়। শরীর যতই খাদ্য থেকে থায়ামিন গ্রহণ করুক, এই অতিরিক্ত পানীয়ের কারণে তার শোষণ বা ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই অভ্যাস বজায় থাকলে ধীরে ধীরে কোষগুলো শক্তি উৎপাদন করতে পারে না।

শিশু, কিশোর ও গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ। খালি পেটে চা বা কফি গ্রহণ করলে পুষ্টি শোষণ আরও কমে যায়। ফলে হাত-পা দুর্বলতা, মনোযোগের অভাব, ক্লান্তি, হাঁটাচলায় অসুবিধা এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া দেখা দিতে পারে।

শহর ও গ্রামে এই অভ্যাস দিন দিন বাড়ছে। অনেক কর্মজীবী ব্যক্তি সকালে কফি পান করে এবং দুপুরে বা বিকালে চা পান করেন। এই অভ্যাস শরীরের থায়ামিন ঘাটতি বৃদ্ধি করে, বিশেষ করে যারা একঘেয়ে খাদ্যাভ্যাসের সাথে মিলিয়ে পান।

অতিরিক্ত চা ও কফি গ্রহণ শুধু থায়ামিন হ্রাস করে না, বরং লোহা ও অন্যান্য খনিজের শোষণেও বাধা সৃষ্টি করে। ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয় এবং সহজে সংক্রমণ ও শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়।

সমাধান হলো চা ও কফি গ্রহণ সীমিত করা। দিনে ১–২ কাপ চা বা কফির বেশি গ্রহণ না করা স্বাস্থ্যকর। এছাড়া থায়ামিন সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন ডাল, বাদাম, শাকসবজি, মাছ ও দুধ নিয়মিত খাওয়া উচিত। শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের জন্য বিশেষভাবে স্বাস্থ্যকর পানীয় বেছে নেওয়া জরুরি।

৯. কিডনি, লিভার বা হৃদরোগজনিত জটিলতায় শরীরের ভিটামিন ব্যবহারে ব্যাঘাত

শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন কিডনি, লিভার এবং হৃদযন্ত্র ভিটামিন শোষণ ও ব্যবহারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যখন এই অঙ্গগুলিতে জটিলতা দেখা দেয়, তখন শরীরের থায়ামিন ব্যবহার ব্যাহত হয়। ফলে পর্যাপ্ত ভিটামিন বি১ থাকা সত্ত্বেও কোষগুলো তা ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারে না, যা ধীরে ধীরে বেরিবেরি রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

কিডনির সমস্যা যেমন দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ, প্রস্রাবের সমস্যা বা ডায়ালিসিসের প্রয়োজন হলে থায়ামিনের শোষণ ও সঞ্চালন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। অনেক সময় রোগীরা পর্যাপ্ত পুষ্টি গ্রহণ করলেও থায়ামিন ঘাটতি তৈরি হয়। ফলে শক্তি উৎপাদন কমে যায়, পেশি দুর্বল হয় এবং হাঁটাচলায় সমস্যা দেখা দেয়।

আরোও পড়ুনঃ  মাল্টা খেলে কি ডায়াবেটিস বাড়ে?

লিভারের রোগ যেমন হেপাটাইটিস, ফ্যাটি লিভার বা দীর্ঘমেয়াদি লিভার প্রদাহ শরীরের ভিটামিন সংরক্ষণ ও ব্যবহার প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। লিভার ঠিকভাবে কাজ না করলে খাবার থেকে পাওয়া ভিটামিন যথাযথভাবে রক্তে প্রবেশ করে না। এটি ধীরে ধীরে শক্তি হ্রাস, ক্লান্তি, মনোযোগ কমে যাওয়া এবং স্নায়ুর দুর্বলতা তৈরি করে।

হৃদরোগের ক্ষেত্রে শরীরের রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয়। রক্তের মাধ্যমে থায়ামিন অঙ্গগুলোতে পৌঁছানো কঠিন হয়। ফলে কোষগুলো পর্যাপ্ত শক্তি উৎপাদন করতে পারে না। রোগীর মধ্যে হাঁটাচলায় অসুবিধা, বুক ধড়ফড় করা, হঠাৎ ক্লান্তি এবং পেশি দুর্বলতার মতো উপসর্গ দেখা দেয়।

শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে এই সমস্যা মারাত্মক প্রভাব ফেলে। শিশুদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, শক্তি উৎপাদন কমে যায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। বয়স্কদের মধ্যে হৃদরোগজনিত ঝুঁকি, স্নায়ুজটিলতা এবং হাঁটাচলায় সমস্যা বেড়ে যায়।

শরীরের অন্যান্য পুষ্টি উপাদানও এই জটিলতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। থায়ামিন ছাড়াও অন্যান্য ভিটামিন ও খনিজ যথাযথভাবে ব্যবহার হয় না। ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়, সহজে সংক্রমণ হয় এবং শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়।

সমাধান হলো কিডনি, লিভার বা হৃদরোগের ক্ষেত্রে নিয়মিত চিকিৎসা নেওয়া এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ নিশ্চিত করা। থায়ামিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন ডাল, বাদাম, শাকসবজি, মাছ ও দুধ নিয়মিত খাওয়া রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।

১০. দরিদ্রতা, অপুষ্টি ও সচেতনতার অভাবে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার না পাওয়া

বাংলাদেশের অনেক গ্রামীণ ও শহুরে পরিবারের মধ্যে দরিদ্রতা একটি বড় সমস্যা। আয়ের সীমাবদ্ধতার কারণে তারা পর্যাপ্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার কিনতে পারে না। সাদা ভাত, আলু এবং চিনি নির্ভর খাদ্যই তাদের দৈনন্দিন জীবনধারার প্রধান অংশ। এর ফলে শরীরে থায়ামিনসহ অন্যান্য ভিটামিনের ঘাটতি তৈরি হয়।

অপুষ্টি বা খাবারের বৈচিত্র্যহীনতা দীর্ঘদিন ধরে থাকলে শরীরের কোষ শক্তি উৎপাদনে অক্ষম হয়ে পড়ে। শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক প্রভাব ফেলে। শিশুদের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়, শক্তি উৎপাদন কমে যায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়। বয়স্কদের মধ্যে হাঁটাচলায় অসুবিধা, ক্লান্তি এবং স্নায়ুজটিলতা দেখা দেয়।

দরিদ্রতার কারণে পরিবারগুলো পর্যাপ্ত প্রোটিন, শাকসবজি, ডাল, মাছ বা দুধের ব্যবস্থা করতে পারে না। ফলস্বরূপ, শরীরে ভিটামিন বি১ সরবরাহ ঠিকভাবে হয় না। দীর্ঘদিন ধরে এই অভ্যাস বজায় থাকলে ধীরে ধীরে শুষ্ক ও ভেজা বেরিবেরি দুইই প্রকট হতে পারে।

সচেতনতার অভাবও একটি বড় কারণ। অনেক পরিবার জানে না যে খাদ্যের বৈচিত্র্য ও ভিটামিন সম্পূরক খাবার না দিলে থায়ামিনের ঘাটতি হবে। ক্লান্তি, দুর্বলতা বা হাঁটাচলায় সমস্যা অনেকেই স্বাভাবিক মনে করেন। ফলে সমস্যা সময়মতো শনাক্ত করা যায় না।

শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি আরও বেশি। পর্যাপ্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার না পাওয়ার ফলে মা ও শিশুর উভয়ের মধ্যে থায়ামিন ঘাটতি তৈরি হয়। শিশুদের মধ্যে হাত-পা দুর্বলতা, মনোযোগ কমে যাওয়া এবং বৃদ্ধির ব্যাঘাত দেখা দেয়।

সমাধান হলো দরিদ্রতা ও সচেতনতার সমস্যার মোকাবিলা করা। সরকার ও এনজিওগুলোর মাধ্যমে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য, ভিটামিন সম্পূরক এবং স্বাস্থ্য শিক্ষার প্রচার করা প্রয়োজন। পরিবারগুলোও খাদ্য তালিকায় শাকসবজি, ডাল, মাছ, বাদাম এবং দুধ অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করতে হবে।

বেরিবেরি রোগের কারণ?

Beriberi disease4

বেরিবেরি রোগের মূল কারণ হলো শরীরে ভিটামিন বি১ বা থায়ামিনের অভাব। থায়ামিন শরীরের শক্তি উৎপাদন, স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রম এবং হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য রক্ষায় অপরিহার্য। যখন খাদ্যাভ্যাসে পর্যাপ্ত থায়ামিন থাকে না, তখন কোষগুলো শক্তি উৎপাদনে ব্যর্থ হয় এবং ধীরে ধীরে রোগের লক্ষণ দেখা দেয়।

অতিরিক্ত পরিশোধিত চাল খাওয়া, একঘেয়ে খাদ্যাভ্যাস, শাকসবজি ও ডালের কম ব্যবহার, দীর্ঘমেয়াদি অ্যালকোহল গ্রহণ এবং খালি পেটে চা বা কফি গ্রহণ থায়ামিন শোষণ কমিয়ে দেয়। এছাড়া হজমজনিত সমস্যা, ডায়রিয়া, বমি, লিভার ও কিডনির জটিলতা শরীরের পুষ্টি ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে।

গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের মধ্যে থায়ামিনের চাহিদা বেশি। যদি খাদ্যতালিকায় যথেষ্ট পুষ্টি না থাকে, তাহলে মা ও শিশুর উভয়ে ঘাটতি দেখা দেয়। শিশুদের দ্রুত বৃদ্ধি ও শক্তি উৎপাদন থায়ামিনের ওপর নির্ভরশীল, তাই ঘাটতি তাদের মধ্যে হাঁটাচলায় সমস্যা, ক্লান্তি এবং দুর্বলতার কারণ হয়।

দরিদ্রতা ও পুষ্টিহীনতার কারণে অনেক পরিবার পর্যাপ্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পান না। সাদা ভাত, আলু ও চিনি নির্ভর খাদ্য দীর্ঘদিন গ্রহণ করলে থায়ামিন ঘাটতি আরও প্রকট হয়। সচেতনতার অভাবও ঘাটতি প্রতিরোধকে কঠিন করে।

বেরিবেরি রোগের লক্ষণ ধীরে ধীরে প্রকট হয়। শুরুতে ক্লান্তি, মনোযোগের ঘাটতি, হাত-পা দুর্বলতা দেখা দেয়। পরে স্নায়ু ও হৃদযন্ত্রের সমস্যাও প্রকট হয়। শুষ্ক বা ভেজা বেরিবেরি উভয়ই দীর্ঘমেয়াদি অভাবের ফল।

শিশু, কিশোর, গর্ভবতী মা এবং বয়স্কদের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি বেশি। যারা একঘেয়ে খাদ্যাভ্যাস, অ্যালকোহল গ্রহণ, বা হজমজনিত সমস্যায় ভোগেন, তাদের মধ্যে থায়ামিন ঘাটতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

সমাধান হলো স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, থায়ামিন সমৃদ্ধ খাবার নিয়মিত গ্রহণ, পুষ্টি সম্পূরক ব্যবহার এবং চিকিৎসা গ্রহণ। ডাল, বাদাম, শাকসবজি, মাছ, দুধ এবং কম পরিশোধিত চাল এই রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।

উপসংহারে, বেরিবেরি রোগের প্রধান কারণ হলো থায়ামিনের অভাব। খাদ্যাভ্যাস, স্বাস্থ্য সচেতনতা, পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য এবং প্রয়োজনমতো চিকিৎসা গ্রহণ রোগ প্রতিরোধে কার্যকর।

বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ

বেরিবেরি রোগ কিসের অভাবে হয়? এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-

বেরিবেরি রোগ কীভাবে শনাক্ত করা যায়?

বেরিবেরি রোগ মূলত ভিটামিন বি১ বা থায়ামিনের ঘাটতির কারণে হয়। শুরুতে রোগী ক্লান্তি, মনোযোগের ঘাটতি, হাত-পা দুর্বলতা ও হাঁটাচলায় সমস্যা অনুভব করতে পারে। যদি অবহেলা করা হয়, তবে স্নায়ু ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসকের পরামর্শে রক্ত পরীক্ষা এবং ভিটামিন স্তর নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নিশ্চিত করা যায়।

বেরিবেরি রোগ প্রতিরোধের সহজ ও কার্যকর উপায় কী?

নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা প্রধান প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কম পরিশোধিত চাল, ডাল, শাকসবজি, বাদাম, মাছ ও দুধ নিয়মিত গ্রহণ থায়ামিনের ঘাটতি পূরণে সহায়ক। গর্ভবতী ও শিশুদের জন্য বিশেষভাবে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার দেওয়া এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে ভিটামিন সম্পূরক গ্রহণ রোগ প্রতিরোধে কার্যকর।

উপসংহার

বেরিবেরি রোগ একটি পুষ্টিজনিত সমস্যা, যা মূলত ভিটামিন বি১ বা থায়ামিনের অভাবে দেখা দেয়। এটি স্নায়ুতন্ত্র, হৃদযন্ত্র এবং শরীরের শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে এটি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, কারণ খাদ্যাভ্যাসে একঘেয়ে খাদ্য, অতিরিক্ত পরিশোধিত চাল এবং শাকসবজি-ডালের কম ব্যবহার প্রচলিত।

শিশু, গর্ভবতী মা, বৃদ্ধ এবং যেসব মানুষ একঘেয়ে খাদ্যাভ্যাস, অ্যালকোহল গ্রহণ বা হজমজনিত সমস্যায় ভোগেন, তাদের মধ্যে রোগের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। রোগ ধীরে ধীরে প্রকট হয়; শুরুতে ক্লান্তি, মনোযোগের ঘাটতি, হাত-পা দুর্বলতা এবং হাঁটাচলায় সমস্যা দেখা দেয়। পরে স্নায়ু ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা প্রকট হয়।

থায়ামিনের ঘাটতি শুধু খাদ্য অভাবের কারণে নয়, বরং হজমজনিত সমস্যা, ডায়রিয়া, লিভার বা কিডনির জটিলতা এবং অ্যালকোহল গ্রহণও এটি বাড়িয়ে দেয়। গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মহিলাদের চাহিদা বেশি হওয়ায় তাদের জন্য ঝুঁকি আরও প্রকট।

রোগ প্রতিরোধে খাদ্যাভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কম পরিশোধিত চাল, ডাল, শাকসবজি, বাদাম, মাছ ও দুধ নিয়মিত খেলে শরীর পর্যাপ্ত থায়ামিন পায়। শিশুদের জন্য ছোট অংশে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো উচিত। বয়স্কদেরও খাদ্য বৈচিত্র্য বজায় রাখতে হবে।

সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে থায়ামিন সম্পূরক গ্রহণ বেরিবেরি প্রতিরোধে কার্যকর। পরিবার, সমাজ এবং সরকারী উদ্যোগ মিলিয়ে পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধি করলে এই রোগ কমানো সম্ভব।

বেরিবেরি রোগ একটি প্রতিরোধযোগ্য সমস্যা। পুষ্টি ঘাটতি চিহ্নিত করা, খাদ্য বৈচিত্র্য বজায় রাখা এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগ করা হলে রোগের প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। তাই, স্বাস্থ্য সচেতনতা, পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *