শিশুর জ্বর না কমলে করণীয়?
শিশুর জ্বর এমন একটি সাধারণ সমস্যা যা প্রায় প্রতিটি বাবা-মাকে কখনও না কখনও চিন্তায় ফেলে। জ্বর মানেই অনেকেই ভাবেন এটি কোনো বড় রোগের লক্ষণ, কিন্তু বাস্তবে জ্বর হলো শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হওয়ার একটি সংকেত। শরীরে কোনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা সংক্রমণ প্রবেশ করলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, যাতে জীবাণুগুলো ধ্বংস হয়। বাংলাদেশে আবহাওয়ার পরিবর্তন, ভাইরাল ইনফেকশন, খাবার বা পরিবেশগত কারণে শিশুদের মধ্যে প্রায়ই জ্বর দেখা যায়।
তবে অনেক সময় দেখা যায়, ওষুধ খাওয়ানোর পরও শিশুর জ্বর কমছে না বা বারবার ফিরে আসছে। এই অবস্থায় বাবা-মায়ের উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু আতঙ্কিত না হয়ে সঠিকভাবে পরিস্থিতি সামলানোই শ্রেয়। শিশুর জ্বর না কমলে আগে তার কারণ খুঁজে বের করা জরুরি। এটি ভাইরাল ইনফেকশন হতে পারে, আবার কানে ইনফেকশন, মূত্রনালি সংক্রমণ, নিউমোনিয়া বা ডেঙ্গুর মতো জটিল কারণেও হতে পারে।
বাংলাদেশে অনেক অভিভাবক নিজেরা ওষুধ দিয়ে শিশুর জ্বর কমানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু এটি অনেক সময় বিপদ ডেকে আনে। কারণ প্রতিটি শিশুর শরীর ভিন্ন, তাই একই চিকিৎসা সবার ক্ষেত্রে কার্যকর হয় না। তাই শিশুর জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
শিশুর জ্বর না কমলে করণীয়?

শিশুর জ্বর অনেক সময় সহজেই কমে যায়, কিন্তু যদি তা না কমে বা দীর্ঘ সময় থাকে, তাহলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। জ্বর না কমলে শিশুর শরীরে ডিহাইড্রেশন, অসুস্থতা বৃদ্ধি এবং অন্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। নিচে জ্বর নিয়ন্ত্রণ ও শিশুর যত্নের জন্য বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া হলো।
১. শিশুর জ্বরের প্রকৃত তাপমাত্রা নির্ণয় করতে কিভাবে নিয়মিত তাপমাত্রা মাপা উচিত এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ
শিশুর জ্বর নির্ণয়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো তার শরীরের তাপমাত্রা সঠিকভাবে মাপা। ডিগিটাল থার্মোমিটার ব্যবহার করা সবচেয়ে নিরাপদ ও নির্ভুল পদ্ধতি। তাপমাত্রা নিয়মিত মাপার মাধ্যমে দেখা যায় জ্বর বাড়ছে, কমছে বা স্থিতিশীল আছে কিনা। বাংলাদেশে অনেক বাবা-মা প্রাথমিক পর্যায়ে জ্বরের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন না, ফলে সঠিক চিকিৎসা বিলম্বিত হয়।
শিশুর বয়স অনুযায়ী থার্মোমিটারের ধরন ও ব্যবহার ভিন্ন। ০–৩ মাস বয়সী শিশুদের জন্য রেকটাল থার্মোমিটার বেশি নির্ভুল। ৩ মাস থেকে ৩ বছর বয়স পর্যন্ত অরাল বা আর্ম-পিট থার্মোমিটার ব্যবহার করা যায়। ৩ বছরের বেশি শিশুদের জন্য সাধারণ ডিজিটাল থার্মোমিটার যথেষ্ট। তাপমাত্রা মাপার সময় শিশুর শান্ত থাকা জরুরি, কারণ আন্দোলন থাকলে ফলাফল ভুল হতে পারে।
শিশুর তাপমাত্রা রাতে সাধারণত বেশি থাকে, সকালে কমে যায়। তাই দিনের বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার তাপমাত্রা মাপা উচিত। একটি নোটবুকে রেকর্ড করে রাখলে ডাক্তার বা পেডিয়াট্রিক চিকিৎসকের কাছে দেখানো সহজ হয়।
শিশুর তাপমাত্রা যদি ১০০°F–১০২°F এর মধ্যে থাকে, তা হালকা জ্বর হিসেবে ধরা হয়। ১০২°F–১০৪°F হলে তা মাঝারি জ্বর এবং ১০৪°F এর বেশি হলে তা গুরুতর। তাপমাত্রার ধরণ অনুযায়ী চিকিৎসা বা ঘরে যত্নের পদ্ধতি নির্ধারণ করা যায়।
শিশুর তাপমাত্রা নিয়মিত মাপার ফলে বাবা-মা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তারা বুঝতে পারেন কখন ওষুধ দেওয়া প্রয়োজন, কখন ঘরে বিশ্রাম ও তরল খাদ্য দেওয়া যথেষ্ট। এটি শিশুর সঠিক যত্ন এবং রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২. জ্বরের সময় শিশুকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও আরাম দিতে কিভাবে ঘর এবং পরিবেশ সাজানো যায়
জ্বরের সময় শিশুর শরীর দুর্বল হয়ে যায়, তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর ঘর ঠান্ডা ও নরম রাখা উচিত, যাতে শরীরের অতিরিক্ত তাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। বাংলাদেশে শীতকালে শিশুর ঘরে হিটার বা ফ্যান ব্যবহার সতর্কতার সঙ্গে করা উচিত।
শিশুকে ময়লা ও ধুলোময়লা পরিবেশ থেকে দূরে রাখুন। বিছানা পরিষ্কার রাখুন, হালকা ও নরম চাদর ব্যবহার করুন। শিশুর পোশাক হালকা ও আরামদায়ক হওয়া উচিত, যাতে ঘাম জমে না এবং শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
শিশুকে খেলাধুলা বা অতিরিক্ত আন্দোলন করতে দেওয়া উচিত নয়। বেশি খেলা বা দৌড়ঝাপ শরীরের শক্তি দ্রুত কমিয়ে দেয় এবং জ্বর আরও বাড়াতে পারে। শিশুকে শান্তভাবে শুয়ে থাকতে উৎসাহিত করুন।
শিশুর পাশে বই, খেলনা বা টিভি রাখা যেতে পারে, যাতে সে বিশ্রামের সময়ও আনন্দিত থাকে। তবে শব্দ ও আলো বেশি না রাখাই ভালো, যাতে ঘুমের গুণগত মান ঠিক থাকে।
শিশুর ঘরে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল নিশ্চিত করুন। যদি সম্ভব হয় জানালা খোলা রেখে হালকা বাতাস আসতে দিন, তবে শীতকালে শিশুকে ঠান্ডা না লাগে তা খেয়াল রাখতে হবে।
৩. শিশুর জ্বরের সময় পর্যাপ্ত তরল খাবার ও ওরস্যালাইন বা ফলের রস দিয়ে পানি শোষণ নিশ্চিত করার নিয়ম
জ্বরের সময় শিশুর শরীর থেকে ঘাম ও তাপের মাধ্যমে প্রচুর পানি বের হয়, ফলে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। বাংলাদেশে গরম এবং আর্দ্র আবহাওয়ায় শিশুদের পানিশূন্যতার ঝুঁকি আরও বেশি। তাই পানি, দুধ, স্যুপ, লেবুর শরবত, ডাবের পানি বা ফলের রস দিয়ে পানি শোষণ নিশ্চিত করতে হবে।
এক বছর বয়সের শিশুদের জন্য ছোট ছোট করে জল খাওয়ানো উচিত। একবারে বেশি খাওয়ালে পেটে সমস্যা হতে পারে। যেসব শিশু এখনো দুধ পান করে, তাদের জন্য মায়ের দুধই সবচেয়ে ভালো। মায়ের দুধ শিশুকে শক্তি ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দেয়।
ওরস্যালাইন (ORS) ব্যবহার করলে শরীরের খনিজের ঘাটতি পূরণ হয়। শিশু যদি বমি করে, তবে অল্প অল্প করে দিতে হবে। ORS তৈরি করার সময় সঠিক পরিমাণ লবণ ও চিনি মেশানো জরুরি, অতিরিক্ত মেশানো হলে বিপদ হতে পারে।
ফলের রস যেমন পাকা আপেল, পেঁপে বা কলা দিয়ে শিশুদের পানিশূন্যতা দূর করা যায়। তবে অতিরিক্ত রস দেওয়া হলে পেট খারাপ হতে পারে। তাই পরিমিত ও সুষম পরিমাণেই খাওয়ানো উচিত।
শিশুর শরীরে পর্যাপ্ত তরল থাকলে জ্বর ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। এটি শিশুকে শক্তি দেয়, ক্লান্তি দূর করে এবং দ্রুত আরোগ্য নিশ্চিত করে।
৪. শিশুর শরীরের তাপমাত্রা কমাতে হালকা গরম পানিতে গোসল বা গা মুছার সঠিক পদ্ধতি এবং সতর্কতা
জ্বরের সময় শিশুর শরীরের তাপমাত্রা কমাতে হালকা গরম পানিতে গোসল কার্যকর। এটি শরীরকে আরাম দেয় এবং অতিরিক্ত তাপ হ্রাস করে। অনেক বাবা-মা ঠান্ডা পানিতে গা মুছতে চান, কিন্তু এটি বিপজ্জনক হতে পারে।
গরম পানিতে হালকা ভাবে কাপড় ভিজিয়ে শিশুর গা মুছুন। মাথা, হাত, পা ও ঘাড়ের অংশ ধীরে ধীরে মুছে নিতে হবে। এতে শিশুর শরীর হঠাৎ ঠান্ডা হবে না।
শিশুকে গোসল করানোর সময় ঘর হালকা উষ্ণ রাখা জরুরি। হঠাৎ ঠান্ডা বাতাসে রাখলে শিশুর শ্বাসকষ্ট বা কাঁপুনি দেখা দিতে পারে।
গরম পানি ব্যবহার করলে শিশুর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমে এবং জ্বরের অস্বস্তি দূর হয়। এটি বিশেষ করে রাতে শিশুকে ভালো ঘুম দেওয়ার জন্য সহায়ক।
শিশুর তাপমাত্রা বেশি হলে দিনে ২–৩ বার হালকা গরম পানি দিয়ে গা মুছে দেওয়া যেতে পারে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে পানি ব্যবহার না করা উত্তম।
৫. শিশুর জ্বর কমাতে ও শরীর সুস্থ রাখতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক ওষুধ দেওয়ার নিয়মাবলী
শিশুর জ্বর কমাতে ওষুধ দেওয়ার আগে অবশ্যই পেডিয়াট্রিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সাধারণত প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন শিশুর জন্য নির্দিষ্ট মাত্রায় দেওয়া হয়।
ওষুধের ডোজ শিশুর ওজন অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়। ডোজ বেশি হলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, যেমন বমি, ডায়রিয়া বা অ্যালার্জি। কম দিলে জ্বর কমবে না।
শিশুর জ্বর কমার জন্য শুধু ওষুধের উপর নির্ভর করা উচিত নয়। বিশ্রাম, পর্যাপ্ত তরল খাবার ও পরিবেশের যত্নও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
চিকিৎসক যদি প্রয়োজন মনে করেন, তবে অন্যান্য অ্যান্টিবায়োটিক বা স্পেশাল ওষুধও দেওয়া যেতে পারে। তবে নিজের ইচ্ছায় ওষুধ পরিবর্তন বা বেশি ডোজ দেওয়া কখনো উচিত নয়।
শিশুর জ্বরের সময় ওষুধ দেওয়ার আগে তার খাদ্য ও পানির খাওয়ার ধরন খেয়াল রাখা উচিত। খালি পেটে কখনোও কিছু ওষুধ না দেওয়াই নিরাপদ।
৬. জ্বরের সময় শিশুর খাওয়ানো খাবারের ধরন ও পুষ্টিকর খাবারের নির্বাচন কিভাবে করা উচিত
জ্বরের সময় শিশুর ক্ষুধা কমে যায়, তাই তাকে জোর করে খাওয়ানো ঠিক নয়। তবে শরীরে শক্তি বজায় রাখতে পুষ্টিকর ও সহজপাচ্য খাবার দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে সাধারণত হালকা খিচুড়ি, সেদ্ধ ভাত, স্যুপ, ডিমভাজি বা সবজি দিয়ে শিশুদের খাবারের পুষ্টি দেওয়া যায়।
ফলের মধ্যে আপেল, কলা, পেঁপে বা তাজা কমলার রস শিশুদের শরীরে শক্তি ও ভিটামিন সরবরাহ করে। এসময় তেল বা মশলাযুক্ত খাবার কম দেওয়া উচিত, কারণ এগুলো হজমে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
শিশুর ক্ষুধা কম থাকলে একবারে বেশি খাবার দেওয়ার পরিবর্তে অল্প অল্প করে দেওয়া ভালো। দিনে কয়েকবার ছোট খাবারের মাধ্যমে পুষ্টি পূরণ করা যেতে পারে।
শিশুর খাওয়া নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করুন। যদি সে পুরোপুরি খাবার না খায়, তবে ওরস্যালাইন বা ফলের রসের মাধ্যমে শক্তি ও খনিজ পূরণ করতে হবে।
শিশুর জন্য খাবার তৈরি করার সময় সতর্ক থাকুন। সবজিগুলো ভালোভাবে ধুয়ে নিন এবং তাজা রান্না করা খাবারই দেওয়া উচিত।
শিশুর জ্বর কমার সাথে সাথে ধীরে ধীরে সাধারণ খাবারে ফেরানো যায়। এতে শিশুর ক্ষুধা ও শক্তি পুনরায় স্থিতিশীল হয়।
৭. শিশুর দ্রুত আরোগ্য ও সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য আশেপাশের পরিবেশ, ঘর ও খেলাধুলার স্থান পরিষ্কার রাখার কৌশল
শিশুর জ্বরের সময় ঘর ও আশেপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা অত্যন্ত জরুরি। ধুলো, ময়লা বা মশার উপস্থিতি সংক্রমণ বাড়াতে পারে। বাংলাদেশে বিশেষ করে বর্ষাকালে মশা ও ব্যাকটেরিয়ার কারণে শিশুর জ্বর বাড়তে পারে।
ঘর নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন। শিশুর বিছানা, চেয়ার, টেবিল ও খেলাধুলার স্থান ধুলো-মুক্ত রাখুন। হালকা ময়লা থাকলেও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
শিশুর ঘরে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল নিশ্চিত করুন। তবে শীতকালে হঠাৎ ঠান্ডা বাতাসে রাখবেন না। শিশুর ঘর উষ্ণ ও হালকা বাতাসে থাকলে আরামবোধ হয়।
শিশুর ব্যবহার করা খেলনা, কাপড় ও খাবারের বर्तन সবসময় পরিষ্কার রাখুন। ব্যাকটেরিয়ার উৎসগুলো দূরে রাখলে জ্বরের সময় দ্রুত আরোগ্য হয়।
শিশুর ঘরে মশা প্রতিরোধ ব্যবস্থা রাখুন। যেমন, মশারি ব্যবহার বা মশা প্রতিরোধক ঘরোয়া লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে।
শিশু যখন ঘরে থাকে, তখন অন্য ভাইরাস বা সংক্রমণ থেকে তাকে দূরে রাখুন। আক্রান্ত বা অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ কমানো ভালো।
৮. জ্বরের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, কাশি বা ফুসফুস সংক্রমণ চিহ্নিত করতে শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস পর্যবেক্ষণের নিয়ম
শিশুর জ্বরের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, কাশি বা শ্বাসের দ্রুততা দেখা দিলে তা ফুসফুসে সংক্রমণের লক্ষণ হতে পারে। বাংলাদেশে শিশুদের নিউমোনিয়া বা ব্রঙ্কাইটিস জ্বরের সঙ্গে সাধারণ সমস্যা।
শ্বাসের গতি, শ্বাস নেওয়ার ধরণ এবং কাঁধ বা পেটে শ্বাসের সময় তোলপাড় হচ্ছে কিনা লক্ষ্য করুন। যদি শ্বাস দ্রুত বা অস্বাভাবিক হয়, দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান।
শিশুর মুখ ও ঠোঁক নীল হয়ে গেলে তা অক্সিজেনের অভাবের লক্ষণ। এটি জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন।
শিশুর কাশি দীর্ঘদিন থাকলে, থুতু বা সাদা/হলুদ কফ দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
শ্বাসকষ্টের অন্যান্য লক্ষণ হলো গলার সংকোচন, নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়ার সমস্যা বা শিশুর অসহনীয় অস্থিরতা।
শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস মনিটর করে রাখলে রোগ প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা যায়, যা দ্রুত আরোগ্য নিশ্চিত করে।
৯. দীর্ঘস্থায়ী জ্বরের ক্ষেত্রে কখন এবং কিভাবে শিশুকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত
যদি শিশুর জ্বর ৩ দিনের বেশি স্থায়ী হয় বা ১০২°F এর ওপরে থাকে, তবে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি। এছাড়া শিশুর খাওয়া বন্ধ করা, ঘুমের সমস্যা, অস্বাভাবিক কান্না বা দুর্বলতা দেখা দিলে দেরি না করে ডাক্তার দেখান।
চিকিৎসক প্রয়োজন হলে রক্ত, প্রস্রাব বা এক্স-রে পরীক্ষা করে জ্বরের প্রকৃত কারণ নির্ধারণ করবেন। বাংলাদেশে ভাইরাল ও ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ শিশুদের মধ্যে সাধারণ, তাই প্রাথমিক চিকিৎসা দেরি করা ঠিক নয়।
শিশুর চিকিৎসার সময় ওষুধের ডোজ ও পদ্ধতি নিয়ে নির্দেশনা মেনে চলুন। নিজের ইচ্ছায় ওষুধ পরিবর্তন বা বাড়ানো বিপদজনক।
চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে শিশুর তাপমাত্রা, খাওয়া, ঘুম ও শারীরিক আচরণ রেকর্ডে রাখুন। এটি ডাক্তারকে সঠিক চিকিৎসা নির্ধারণে সাহায্য করে।
শিশুর চিকিৎসা সঠিক সময়ে করলে জ্বর দ্রুত কমে এবং কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয় না।
১০. শিশুর জ্বরের সময় গৃহে করণীয় ও করণীয় নয় এমন অভ্যাস ও সতর্কতা মেনে চলার উপায়
শিশুর জ্বরের সময় কিছু অভ্যাস অবশ্যই অনুসরণ করা উচিত, যেমন পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পর্যাপ্ত পানি ও পুষ্টিকর খাবার দেওয়া। শিশুকে হালকা কাপড় পরানো, ঘর পরিষ্কার রাখা এবং গরম পানি দিয়ে গা মুছা গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু করণীয় নয় এমন অভ্যাসও রয়েছে। ঠান্ডা পানি দিয়ে গা মুছা, অতিরিক্ত হিউমিডিফায়ার ব্যবহার, জোর করে খাওয়ানো বা হঠাৎ ঠান্ডা বাতাসে রাখা উচিত নয়।
শিশুর জ্বরের সময় বাবা-মায়ের ধৈর্যশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর শরীর নিজেই সংক্রমণ প্রতিরোধ করার প্রক্রিয়া চালায়।
শিশু ধীরে ধীরে সুস্থ হবে, তাই আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য ধরে পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। সঠিক যত্ন, চিকিৎসা ও পর্যাপ্ত পুষ্টি শিশুকে দ্রুত আরোগ্য দেয়।
শিশুর জন্য ঘরে সতর্কতা, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পর্যাপ্ত পানি, পুষ্টিকর খাবার এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশ—এগুলো মেনে চললে জ্বর কমানোর প্রক্রিয়া সহজ হয়।
শিশুর জ্বর হলে ঘরোয়া চিকিৎসা

শিশুর জ্বর হলো শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হওয়ার একটি প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া। বেশিরভাগ জ্বর ভাইরাল সংক্রমণের কারণে হয় এবং খুব বেশি জটিলতা সৃষ্টি করে না। তাই ঘরোয়া চিকিৎসা প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক সময় কার্যকর হতে পারে, বিশেষ করে ছোট ও হালকা জ্বরের ক্ষেত্রে। তবে ঘরোয়া চিকিৎসা শুরু করার আগে শিশুর বয়স, জ্বরের মাত্রা এবং অন্যান্য উপসর্গ খেয়াল রাখা জরুরি।
প্রথম ধাপ হলো শিশুকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দেওয়া। শিশুর শরীর দুর্বল হয়ে গেলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই তাকে আরামদায়ক ঘরে রাখা, হালকা কাপড় পরানো এবং ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা পরিবেশে রাখলে জ্বর বাড়তে পারে।
শিশুকে পর্যাপ্ত তরল খাবার দেওয়া অপরিহার্য। জ্বরের সময় শরীর থেকে ঘাম ও পানি বের হয়, ফলে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। তাই পানি, দুধ, স্যুপ, লেবুর শরবত বা ডাবের পানি দেওয়া উচিত। এক বছর বয়সের শিশুদের জন্য ছোট ছোট করে পানি খাওয়ানো ভালো, যাতে পেট খারাপ না হয়।
ORS (ওরস্যালাইন) ব্যবহার শিশুর শরীরের খনিজের ঘাটতি পূরণ করতে সাহায্য করে। বিশেষ করে ডায়রিয়া বা বমির সাথে জ্বর থাকলে ORS অপরিহার্য। প্রস্তুত করতে গেলে সঠিক মাত্রায় লবণ ও চিনি মেশানো উচিত।
শিশুর তাপমাত্রা নিয়মিত মাপা ঘরোয়া চিকিৎসার অংশ। ডিজিটাল থার্মোমিটার দিয়ে প্রতি ৪–৬ ঘণ্টা পর পর মাপা উচিত। তাপমাত্রার ওঠানামা বুঝে ঘরোয়া চিকিৎসার ধরণ নির্ধারণ করা যায়। যেমন, হালকা জ্বরের ক্ষেত্রে শুধু বিশ্রাম ও তরল খাবার যথেষ্ট হতে পারে।
শিশুর গা মুছতে হালকা গরম পানি ব্যবহার করা যায়। এটি শরীরের অতিরিক্ত তাপ কমায় এবং জ্বরের অস্বস্তি দূর করে। তবে ঠান্ডা পানি ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ এটি শিশুকে কাঁপুনি ও শ্বাসকষ্ট দিতে পারে।
হালকা ও সহজপাচ্য খাবার খাওয়ানো দরকার। খিচুড়ি, সেদ্ধ ভাত, সবজি, ডিমভাজি, হালকা স্যুপ শিশুর শরীরে শক্তি ও পুষ্টি যোগায়। ঝাল, তেলযুক্ত বা অতিরিক্ত মশলাযুক্ত খাবার এসময় এড়ানো উচিত।
শিশুর ঘর ও আশেপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখা অপরিহার্য। ধুলো, ময়লা ও মশা সংক্রমণ বাড়াতে পারে। তাই বিছানা, কাপড়, খেলনা ও ঘর নিয়মিত পরিষ্কার করা উচিত।
শিশুর তাপমাত্রা হঠাৎ বাড়লে বা কাশি, শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে ঘরোয়া চিকিৎসার সীমা ছাড়িয়ে যায়। তখন অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। বাংলাদেশে শিশুদের নিউমোনিয়া বা ডেঙ্গু জ্বরের সময় বাড়তে পারে, তাই প্রাথমিক সতর্কতা নেয়া জরুরি।
শিশুর ঘরোয়া চিকিৎসার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো শান্তিপূর্ণ ও আরামদায়ক পরিবেশে জ্বর কমানো। বাবা-মায়ের ধৈর্য, পর্যাপ্ত খাবার, পানি, পরিষ্কার পরিবেশ ও পর্যবেক্ষণ শিশুকে দ্রুত সুস্থ করে। তবে, কোনো জটিলতা বা দীর্ঘস্থায়ী জ্বর দেখা দিলে ঘরোয়া চিকিৎসার পাশাপাশি ডাক্তারি পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।
সংক্ষেপে, শিশুর জ্বর হলে ঘরোয়া চিকিৎসা হালকা জ্বরের ক্ষেত্রে কার্যকর এবং এটি শিশুকে দ্রুত আরাম দেয়। তবে সতর্কতা ও পর্যবেক্ষণ অপরিহার্য, কারণ সময়মতো চিকিৎসা না নিলে সমস্যা বাড়তে পারে। ঘরোয়া চিকিৎসার মূল বিষয় হলো—বিশ্রাম, পর্যাপ্ত তরল ও পুষ্টিকর খাবার, ঘর পরিষ্কার রাখা, তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ এবং শিশুর আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
শিশুর জ্বর না কমলে করণীয়? এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
শিশুর জ্বর কত দিন থাকলে ঘরোয়া চিকিৎসা যথেষ্ট এবং কখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত?
সাধারণত হালকা জ্বর ১–২ দিন থাকলে ঘরোয়া চিকিৎসা যথেষ্ট হতে পারে। এই সময়ে শিশুকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পর্যাপ্ত পানি ও সহজপাচ্য খাবার দেওয়া উচিত। তবে জ্বর ৩ দিনের বেশি স্থায়ী হলে, তাপমাত্রা ১০২°F এর ওপরে গেলে বা শিশুর আচরণ অস্বাভাবিক হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া শ্বাসকষ্ট, বমি, দুর্বলতা বা খাওয়া বন্ধ করলে তা প্রাথমিক সতর্কতার সংকেত।
জ্বর কমানোর জন্য ঘরোয়া চিকিৎসায় কোন কোন ধাপ সবচেয়ে কার্যকর এবং সতর্কতা কী কী রাখা উচিত?
শিশুর জ্বর কমাতে ঘরোয়া চিকিৎসায় সবচেয়ে কার্যকর হলো—পর্যাপ্ত বিশ্রাম, হালকা ও পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত পানি বা ORS দেওয়া, তাপমাত্রা নিয়মিত মাপা এবং হালকা গরম পানিতে গা মুছে দেওয়া। সতর্ক থাকতে হবে ঠান্ডা পানি ব্যবহার, অতিরিক্ত জোর করে খাওয়ানো বা হঠাৎ ঠান্ডা বাতাসে রাখার ক্ষেত্রে। এই ধাপগুলো মেনে চললে শিশুর জ্বর ধীরে ধীরে কমে এবং শরীর স্বাভাবিকভাবে শক্তি ফিরে পায়।
উপসংহার
শিশুর জ্বর একটি সাধারণ, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সংকেত যা প্রায় প্রতিটি বাবা-মার কাছে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটি প্রমাণ করে যে শিশুর শরীর সংক্রমণ বা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করছে। বাংলাদেশে, যেখানে আবহাওয়া দ্রুত পরিবর্তিত হয় এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে, শিশুর জ্বরকে軽ভাবে নেওয়া ঠিক নয়। জ্বরকে প্রাথমিকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
শিশুর জ্বর না কমলে বা দীর্ঘস্থায়ী হলে অভিভাবকরা প্রাথমিকভাবে ঘরোয়া চিকিৎসা শুরু করতে পারেন। এর মধ্যে রয়েছে পর্যাপ্ত বিশ্রাম, তরল খাবার, হালকা ও সহজপাচ্য খাবার এবং শরীরের তাপমাত্রা নিয়মিত মাপা। শিশুর ঘর পরিষ্কার রাখা, ধুলো ও মশা দূর করা, এবং আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা শিশুর দ্রুত আরোগ্য নিশ্চিত করে।
ঘরোয়া চিকিৎসা হালকা জ্বরের ক্ষেত্রে কার্যকর হলেও, এটি সীমিত। যদি জ্বর ৩–৪ দিনের বেশি স্থায়ী হয়, ১০২°F এর ওপরে থাকে, বা শিশুর আচরণ অস্বাভাবিক হয়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ জরুরি। শিশুর শ্বাসকষ্ট, কাশি, দুর্বলতা বা খাবারের অনীহা থাকলে তা গুরুতর অবস্থার সংকেত হতে পারে।
শিশুর জ্বরের সময় ওষুধ দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বদা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। নিজের ইচ্ছায় বা ডোজ বাড়ানো বিপজ্জনক। প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন শিশুর ক্ষেত্রে নিরাপদ, তবে ওজন ও বয়স অনুযায়ী। ওষুধের পাশাপাশি বিশ্রাম, পর্যাপ্ত পানি ও পুষ্টিকর খাবার শিশুর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
শিশুর জ্বরের সময় বাবা-মায়ের ধৈর্য ও মনোযোগ অপরিহার্য। শিশুকে জোর করে খাওয়ানো বা অযথা আতঙ্কিত হওয়া সমস্যা বাড়াতে পারে। শিশুর শরীর নিজেই সংক্রমণ প্রতিরোধে কাজ করে, তাই পর্যবেক্ষণ ও সঠিক যত্নই মূল।
শিশুর ঘরোয়া যত্নে নিয়মিত তাপমাত্রা মাপা, হালকা গরম পানিতে গা মুছা, পর্যাপ্ত পানি ও খাবার দেওয়া, ঘর পরিষ্কার রাখা এবং আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া শিশুর খাওয়া ও ঘুমের ধরন পর্যবেক্ষণ করলে জ্বরের প্রকৃত অবস্থা বোঝা সহজ হয়।
শিশুর দ্রুত আরোগ্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে শিশুদের জন্য নিয়মিত হালকা খিচুড়ি, স্যুপ, সবজি, ফল ও দুধের মতো খাবার খাওয়ানো বিশেষভাবে সহায়ক। ঘরোয়া চিকিৎসা শিশুকে স্বাভাবিক ও আরামদায়ক পরিবেশ দেয়, যা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা সক্রিয় রাখে।
শেষমেশ বলা যায়, শিশুর জ্বর শুধু রোগের লক্ষণ নয়, এটি শিশুর দেহের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার অংশ। অভিভাবকদের উচিত ধৈর্য ধরে পর্যবেক্ষণ করা, সঠিক ঘরোয়া যত্ন নেওয়া এবং প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করতে বাবা-মা যেন জ্বরের ধরণ, তাপমাত্রা, খাওয়া, ঘুম, শারীরিক আচরণ ও শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন। যথাযথ সময়ে ঘরোয়া যত্ন ও চিকিৎসা মিলিয়ে শিশুর দ্রুত সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব।
সংক্ষেপে—শিশুর জ্বরের প্রতি নজর রাখুন, ঘরোয়া যত্ন দিন, পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করুন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এটি শিশুর সুস্থতা ও নিরাপত্তার মূল চাবিকাঠি।
