Infectious and non-communicable diseases1

সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে করণীয়?

মানবজীবনে স্বাস্থ্য একটি অমূল্য সম্পদ। সুস্থ দেহ এবং সুস্থ মন ছাড়া কারো পক্ষে সুখী জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। কিন্তু পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ কমবেশি রোগের শিকার হয়। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ, যেখানে সংক্রামক এবং অসংক্রামক রোগ উভয়ের প্রকোপই দেখা যায়। এসব রোগ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল ও শহুরে জীবনের ভিন্নতা, পানির মান, খাদ্যাভ্যাস, পরিবেশ দূষণ, জনসংখ্যার চাপ, এবং সচেতনতার অভাব রোগের বিস্তারে প্রধান ভূমিকা রাখে। শহরে ফাস্টফুড, ধূমপান, মদ্যপান ও ব্যায়ামের অভাবজনিত অসংক্রামক রোগ বেড়ে চলছে। অপরদিকে গ্রামে দূষিত পানি, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যসেবার সীমিত প্রাপ্যতার কারণে সংক্রামক রোগ বেশি দেখা যায়।

সংক্রামক রোগ সাধারণত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী বা ফাঙ্গাস দ্বারা ছড়ায়। একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যেমন ডায়রিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি। এ ধরনের রোগ অল্প সময়েই মহামারী আকার ধারণ করতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এগুলোর বিস্তার আরও বেশি হয়।

অন্যদিকে অসংক্রামক রোগ হলো এমন রোগ যা সরাসরি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে ছড়ায় না। বরং দীর্ঘমেয়াদি জীবনযাত্রার ধরণ, খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ, জিনগত কারণ এবং পরিবেশগত প্রভাব থেকে এ ধরনের রোগ সৃষ্টি হয়। যেমন – উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার, হাঁপানি ইত্যাদি।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই দুটি রোগের সমান্তরাল বৃদ্ধি। গ্রামে সংক্রামক রোগের প্রকোপ বেশি, আর শহরে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ফলে স্বাস্থ্যখাতে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের চেষ্টা করলেও, সচেতনতার ঘাটতির কারণে সাধারণ মানুষ এখনও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, অধিকাংশ রোগ প্রতিরোধযোগ্য। মানুষ যদি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন হয়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকে, বিশুদ্ধ পানি পান করে, সুষম খাদ্য খায় এবং নিয়মিত শরীরচর্চা করে, তবে অনেক রোগ এড়ানো সম্ভব। এছাড়া নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করালে রোগ প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে, যা চিকিৎসাকে সহজ করে তোলে।

এছাড়াও পরিবার ও সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। কারণ একজন অসচেতন ব্যক্তি পুরো পরিবার কিংবা সমাজকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। যেমন একজন ডেঙ্গু রোগী যদি সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না নেয় বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেয়, তবে তার আশেপাশের মানুষও আক্রান্ত হতে পারে। একইভাবে একজন ধূমপায়ী শুধু নিজের নয়, আশেপাশের মানুষেরও ক্ষতি করে।

তাই স্বাস্থ্যসচেতন সমাজ গড়ে তুলতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকে স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পত্রিকা এবং কমিউনিটি পর্যায়ে প্রচারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে কীভাবে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করা যায়।

রোগ প্রতিরোধ শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। একটি সুস্থ জাতি দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। অসুস্থ জনশক্তি অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, উৎপাদনশীলতা কমে যায় এবং স্বাস্থ্য খাতে বাড়তি ব্যয় তৈরি হয়।

তাই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত – রোগ হলে চিকিৎসা নয়, বরং রোগ হওয়ার আগেই তা প্রতিরোধ করা। এজন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সচেতনতা, গবেষণা, আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা, এবং স্বাস্থ্যখাতে সঠিক বিনিয়োগ।

এই আলোচনায় আমরা বিস্তারিতভাবে জানব – সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ কী কী, সেগুলো প্রতিরোধে কী করণীয়, এদের মধ্যে পার্থক্য কী এবং আমাদের কীভাবে সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব।

সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের নাম

Infectious and non-communicable diseases2

রোগকে সাধারণভাবে দুই ভাগে ভাগ করা হয় – সংক্রামক ও অসংক্রামক। সংক্রামক রোগ হলো এমন রোগ যা এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ছড়ায়। অপরদিকে অসংক্রামক রোগ একেবারেই ছোঁয়াচে নয়, বরং ধীরে ধীরে শরীরে বিকাশ ঘটে এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়। বাংলাদেশে দুটি ধরণের রোগই প্রচুর দেখা যায়। নিচে আলাদাভাবে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের নাম উল্লেখ করা হলো।

সংক্রামক রোগের নাম

১. যক্ষ্মা (TB): বাংলাদেশে অন্যতম প্রধান সংক্রামক রোগ, যা কাশি, জ্বর ও রক্ত ওঠার মাধ্যমে চিহ্নিত হয়।
২. ডায়রিয়া: দূষিত পানি ও খাবারের কারণে দ্রুত ছড়ায়, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে মারাত্মক।
৩. টাইফয়েড: দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়ানো একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ।
৪. ডেঙ্গু জ্বর: এডিস মশার কামড়ে ছড়ায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে।
5. ম্যালেরিয়া: অ্যানোফিলিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়, মূলত পাহাড়ি ও বনাঞ্চলে বেশি দেখা যায়।
6. হেপাটাইটিস বি ও সি: ভাইরাসজনিত রোগ, যা রক্ত ও শরীরবাহিত তরলের মাধ্যমে ছড়ায়।
7. এইডস (HIV/AIDS): অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক, রক্ত সঞ্চালন ও সূঁচ ব্যবহারের মাধ্যমে ছড়ায়।
8. হাম: শিশুদের মধ্যে বেশি হয় এবং দ্রুত সংক্রমণ ঘটায়।
9. ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা: মৌসুমি ভাইরাসজনিত রোগ, যা শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে ছড়ায়।
10. কলেরা: দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে দ্রুত ছড়ানো একটি প্রাণঘাতী রোগ।

এসব রোগ বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য সংকট তৈরি করে, বিশেষ করে বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা স্যানিটেশনের ঘাটতির সময় এগুলো মহামারী আকারে দেখা দেয়।

অসংক্রামক রোগের নাম

১. ডায়াবেটিস: অগ্ন্যাশয়ে ইনসুলিন উৎপাদনে সমস্যা বা ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার ফলে হয়।
২. উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension): অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস ও মানসিক চাপের কারণে বাড়ে।
৩. হৃদরোগ: ধমনীতে চর্বি জমে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি তৈরি করে।
৪. ক্যান্সার: শরীরের কোষ অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করলে ক্যান্সার হয়।
৫. হাঁপানি বা অ্যাজমা: শ্বাসকষ্টজনিত দীর্ঘমেয়াদি অসুখ।
৬. কিডনি রোগ: দীর্ঘমেয়াদি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রার কারণে হয়।
৭. স্ট্রোক: মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে স্ট্রোক হয়।
৮. মোটাপানা (Obesity): অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ ও শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে হয়।
৯. আরথ্রাইটিস (সন্ধিবাত): হাড় ও জয়েন্টে প্রদাহ সৃষ্টি হয়।
১০. অ্যালঝাইমারস রোগ: বার্ধক্যজনিত স্নায়বিক অসুখ, যা স্মৃতিশক্তি নষ্ট করে দেয়।

অসংক্রামক রোগগুলো সাধারণত হঠাৎ হয় না। এগুলো বছরের পর বছর ধরে ধীরে ধীরে শরীরে গড়ে ওঠে। খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রার ধরণ, মানসিক চাপ, ধূমপান, মদ্যপান এবং ব্যায়ামের অভাব এগুলোর প্রধান কারণ।

বাংলাদেশে আগে সংক্রামক রোগই বেশি দেখা যেত, কিন্তু বর্তমানে অসংক্রামক রোগের হারও দ্রুত বাড়ছে। শহরে আধুনিক জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর খাবার, দূষণ ও কর্মব্যস্ত জীবন এর মূল কারণ।

সারসংক্ষেপে বলা যায়,

  • সংক্রামক রোগ: দ্রুত ছড়ায়, যেমন ডায়রিয়া, যক্ষ্মা, ডেঙ্গু।
  • অসংক্রামক রোগ: ধীরে ধীরে হয়, যেমন ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ।

বাংলাদেশে দুটি ধরনের রোগই বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। তাই উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে করণীয়

Infectious and non-communicable diseases3

রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা ও সঠিক জীবনধারা অপরিহার্য। সংক্রামক রোগ এড়াতে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, স্যানিটেশন ও পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সুষম খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক স্থিরতা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি। প্রতিটি মানুষকে নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্যের জন্য দায়িত্ব নিতে হবে।

১. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবনধারা

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবনধারা সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের মূল ভিত্তি। দৈনন্দিন জীবনে হাত ধোয়া, দেহ ও পোশাক পরিচ্ছন্ন রাখা, বাসা ও আশেপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় স্যানিটেশন কম হওয়ায় ডায়রিয়া, টাইফয়েড ও কলেরা বিস্তারের ঝুঁকি বেশি থাকে। শহরাঞ্চলেও আবর্জনা অপসারণ ও সঠিক ডাস্টবিন ব্যবহারের অভাবের কারণে ডেঙ্গু ও মশা জনিত রোগ বাড়ছে।

হাত ধোয়ার নিয়মিত অভ্যাস সংক্রমণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ। খাবার আগে ও শৌচাগার ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়া সংক্রমণ কমায়। শিশুরা ছোট থেকেই এই অভ্যাস তৈরি করলে ভবিষ্যতে রোগ প্রতিরোধে সুবিধা হয়।

বাড়ির ভেতর ও বাহিরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। রান্নাঘর, বাথরুম ও শৌচাগার নিয়মিত পরিষ্কার করা উচিত। ধুলা, ময়লা ও পানি জমে থাকা জায়গায় ব্যাকটেরিয়া ও মশার জন্ম হয়। তাই পানি জমা না হওয়া, ময়লা ফেলার সঠিক ব্যবস্থা, এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।

পোষা প্রাণী ও শিশুদের খেলাধুলার স্থানও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। তাদের স্পর্শে ময়লা বা ভাইরাস ছড়ানো কমানো যায়। এছাড়া, বর্জ্য ও খাদ্যদ্রব্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব।

সঠিক পরিপাটি জীবনধারা মানে শুধু নিজের পরিচ্ছন্নতা নয়, পরিবার ও সমাজের সুস্থতার দায়িত্ব নেওয়া। নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা রুটিন পালন করলে সংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গড়ে ওঠে।

২. বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার

শরীরের জন্য পানির গুরুত্ব অপরিসীম। পানির মাধ্যমে দেহে জল সরবরাহ হয়, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ হয় এবং শরীরের বর্জ্য পদার্থ বের হয়। তবে যদি পানিটি দূষিত হয়, তা সরাসরি সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। বাংলাদেশে বিশেষ করে গ্রামীণ ও নদীমুখী এলাকায় দূষিত পানি দ্বারা ডায়রিয়া, টাইফয়েড, কলেরা ও হেপাটাইটিসের প্রাদুর্ভাব বেশি। তাই বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি।

আরোও পড়ুনঃ  গর্ভাবস্থায় কামরাঙ্গা খাওয়ার উপকারিতা সমূহ

সরাসরি নদী, খাল বা ঝর্ণার পানি ব্যবহার বিপজ্জনক। পানি ফিল্টার, সিলভার রূপান্তর বা রোদে সিদ্ধ করার মাধ্যমে পানি বিশুদ্ধ করা যায়। ছোট শিশুরা সহজেই দূষিত পানিতে সংক্রমিত হতে পারে, তাই পরিবারের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

পানির সংরক্ষণেও সতর্ক থাকা জরুরি। খোলা বাসন, ড্রাম বা ট্যাঙ্কে পানি রাখা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধির কারণ হয়। ঢাকনা দিয়ে পানি রাখা এবং নিয়মিত পরিষ্কার করা সংক্রমণ রোধে সাহায্য করে।

শহরে পানির সরবরাহ থাকলেও পাইপলাইনে কখনো ব্যাকটেরিয়া বা রাসায়নিক দূষণ থাকতে পারে। তাই পানির গুণমান পরীক্ষা করা এবং প্রয়োজনে ফিল্টার বা বয়লিং করা প্রয়োজন।

হাত ধোয়া, রান্না করা বা পানীয় হিসেবে পানি ব্যবহারের আগে অবশ্যই বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যালয়, অফিস ও হাসপাতালেও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা সমাজের জন্য জরুরি।

শিশুদের প্রতি বিশেষ যত্ন নিলে সংক্রমণ কমানো সম্ভব। শিশুর বোতল, খাবারের পানি, সূপ বা দুধ সবই বিশুদ্ধ পানি দিয়ে প্রস্তুত করতে হবে। পরিবারে নিয়মিত সচেতনতা বাড়ালে দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে।

নদী বা পুকুরের পানি ব্যবহার করার সময় ভেষজ ফিল্টার, কেমিক্যাল বা রোদে সিদ্ধ করার পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। এটি সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধে কার্যকর।

সরকারি ও স্থানীয় স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং পানির মান নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মনিটরিং করে। মানুষকেও সচেতন হতে হবে যেন তারা দূষিত পানি ব্যবহার না করে।

পরিশেষে, বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার শুধু স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য নয়, পরিবারের সদস্য ও সমাজকে সংক্রামক রোগ থেকে রক্ষা করার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

৩. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের দেশে অনেকে প্রক্রিয়াজাত বা ফাস্টফুড খায়, যা দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। অন্যদিকে, পুষ্টিকর খাবার, তাজা সবজি, ফলমূল ও পর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে প্রাকৃতিক খাবারের গুরুত্ব অপরিসীম। সবজি ও শাকসবজি ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সরবরাহ করে। এগুলো শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক।

ফলমূল যেমন আম, কলা, কমলা, পেয়ারা এবং মরিচ শীতল, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ যা সংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমায়। এছাড়া, বিভিন্ন ধরনের বাদাম ও বীজ শরীরকে শক্তি যোগায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে।

প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাছ, ডিম, মাংস এবং দুধের পণ্য শরীরের কোষ গঠনে সাহায্য করে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য সুষম প্রোটিন গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে শর্করা ও ফ্যাট গ্রহণ করতে হবে, তবে অতিরিক্ত চিনির ব্যবহার বা তেল বেশি খাওয়া অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ফাস্টফুড ও হাই-ফ্যাট খাবার এড়ানো উচিত।

খাবারের সময় পরিষ্কার পরিবেশ বজায় রাখা জরুরি। রান্নার সময় হাত ধোয়া, কাঁচামাল ধোয়া এবং রান্নাঘর পরিচ্ছন্ন রাখা সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

পানি ও তরল পদার্থ যথেষ্ট গ্রহণ করলে শরীরের হাইড্রেশন বজায় থাকে। পানি, লেবুর জল, দুধ ও সূপ গ্রহণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

খাবারের সময় নিয়মিত ছোট পরিমাণে খাওয়া এবং রাত্রি খাবার হালকা রাখা পाचनতন্ত্রকে সুস্থ রাখে। এটি ডায়াবেটিস ও ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের জন্য ক্ষতিকর। লবণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে খাবার প্রস্তুত করলে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমে।

পরিবার ও স্কুল পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস শেখানো জরুরি। শিশুদের ছোট বয়স থেকে সুষম খাবারের অভ্যাস গড়ে তুললে ভবিষ্যতে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমানো যায়।

সংক্ষেপে বলা যায়, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস শুধু দেহকে শক্তিশালী করে না, এটি সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। প্রতিদিন পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত পানি এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করলে সুস্থ জীবনধারা বজায় রাখা সহজ হয়।

৪. নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক কার্যক্রম

নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক কার্যক্রম অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে ব্যস্ত জীবনযাপনের কারণে অনেকে শারীরিক পরিশ্রম কম করেন, যা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং স্থূলতার ঝুঁকি বাড়ায়। গ্রামীণ এলাকায় যদিও মানুষ কিছুটা বেশি চলাফেরা করে, তবে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার এবং sedentary lifestyle ও অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা শরীরের মেটাবলিজম বৃদ্ধি করে। হাঁটা, দৌড়ানো, সাইক্লিং বা সাঁতার ইত্যাদি কার্যক্রম হৃদপিন্ড ও শ্বাসপ্রণালী সুস্থ রাখে। এতে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি অসুখের ঝুঁকি কমে।

শিশু ও কিশোরদের জন্য খেলাধুলা ও শারীরিক কার্যক্রম অপরিহার্য। ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, দৌড়ানো বা রোদের মধ্যে খেলা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করে। একইভাবে বৃদ্ধ ও মধ্যবয়সীদের জন্য হালকা ব্যায়াম যেমন হাঁটা, যোগব্যায়াম বা হালকা শক্তি অনুশীলন স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।

ব্যায়াম শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিয়মিত ব্যায়াম স্ট্রেস হরমোন কমায়, ঘুমের মান উন্নত করে এবং মানসিক চাপ কমিয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

শারীরিক কার্যক্রমের মাধ্যমে শরীরের শক্তি ও ইমিউনিটি বৃদ্ধি পায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়লে সংক্রামক রোগ যেমন ভাইরাসজনিত জ্বর, ফ্লু, ডায়রিয়া থেকে বাঁচা সহজ হয়।

অফিস বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ সময় বসে থাকার পরিবর্তে মাঝেমধ্যেই উঠে হাঁটা বা স্ট্রেচিং করা শরীরের জন্য উপকারী। এটি রক্তচলাচল উন্নত করে, পেশী দৃঢ় রাখে এবং দীর্ঘমেয়াদে স্থূলতা ও ব্যথা প্রতিরোধ করে।

নিয়মিত ব্যায়ামের সাথে সঠিক খাবার গ্রহণ ও পর্যাপ্ত ঘুম সমন্বয় করলে শরীর সম্পূর্ণভাবে সুস্থ থাকে। বিশেষ করে সুষম প্রোটিন ও শাকসবজি গ্রহণ করলে পেশী গঠন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

পরিবার ও সমাজ পর্যায়ে ব্যায়ামকে সাধারণ জীবনের অংশ হিসেবে গড়ে তুললে, শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই স্বাস্থ্যকর জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়। স্কুল, কলেজ এবং অফিসেও সক্রিয় জীবনধারার প্রচার প্রয়োজন।

গ্রামে কৃষিকাজ ও দৈনন্দিন কাজের মাধ্যমে কিছুটা ব্যায়াম হলেও আধুনিক যন্ত্র ও গাড়ির ব্যবহার এটি কমিয়ে দিয়েছে। তাই সবাইকে নিজের শারীরিক স্বাস্থ্য সচেতনভাবে নিশ্চিত করতে ব্যায়ামের অভ্যাস তৈরি করতে হবে।

শারীরিক কার্যক্রম শুধু রোগ প্রতিরোধেই নয়, ওজন নিয়ন্ত্রণ, পেশীর শক্তি বৃদ্ধি, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানো, মানসিক চাপ হ্রাস এবং দীর্ঘায়ু নিশ্চিত করার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পরিশেষে বলা যায়, নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক কার্যক্রম ছাড়া স্বাস্থ্যকর জীবনধারা সম্পূর্ণ হতে পারে না। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০–৬০ মিনিট ব্যায়াম এবং সক্রিয় জীবনধারা মানলে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।

৫. পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক স্বাস্থ্য

পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মানুষ প্রায়ই ব্যস্ত জীবনযাপন এবং চাপের কারণে পর্যাপ্ত ঘুম পান না। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায় এবং মানসিক চাপ বাড়ায়, যা দীর্ঘমেয়াদে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

শরীরের জন্য প্রতিদিন ৭–৮ ঘণ্টা ঘুম অপরিহার্য। পর্যাপ্ত ঘুম শরীরের কোষ পুনর্গঠন, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা উন্নত করে। শিশু ও কিশোরদের জন্য আরও বেশি ঘুম প্রয়োজন। কম ঘুম মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে, যার ফলে অবসাদ, উদ্বেগ এবং ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

মানসিক চাপ কমানোও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কাজের চাপ, অর্থনৈতিক সমস্যা, পারিবারিক চাপ এবং শহুরে জীবনের তাড়া মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নষ্ট করে। মানসিক চাপ দীর্ঘমেয়াদে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, যা উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।

ধ্যান, যোগব্যায়াম, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম এবং হালকা হাঁটা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এই অভ্যাস শরীরের কর্টিসল হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে এবং মনকে শান্ত রাখে।

পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নিয়মিত রুটিন তৈরি করা জরুরি। রাতের ঘুম নির্দিষ্ট সময়ে শুরু করা এবং সকালে ঠিক সময়ে ওঠা শরীরের ঘড়ি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

সামাজিক সংযোগ ও পরিবার-বন্ধুর সাথে সময় কাটানো মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। একাকিত্ব এবং মানসিক চাপ দীর্ঘমেয়াদে শরীরকে দুর্বল করে এবং অসুস্থতার ঝুঁকি বাড়ায়।

শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম এবং খেলাধুলা মানসিক স্বাস্থ্য এবং শারীরিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। স্কুল ও কলেজে ঘুমের অভ্যাস উন্নত করার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা দেওয়া প্রয়োজন।

আরোও পড়ুনঃ  গর্ভাবস্থায় জাফরান খেলে কি বাচ্চা ফর্সা হয়?

অফিসে দীর্ঘ সময় কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করার কারণে মানসিক চাপ ও চোখের সমস্যা বাড়ে। নিয়মিত বিরতি, ছোট হাঁটা বা স্ট্রেচিং এবং চোখের ব্যায়াম মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।

পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখা শুধুমাত্র সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে নয়, অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ। কম ঘুম ও মানসিক চাপ ওজন বৃদ্ধি, হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত করা এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

পরিশেষে বলা যায়, প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুম, মানসিক চাপ কমানো এবং নিয়মিত শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম নিশ্চিত করা এক স্বাস্থ্যকর জীবনধারার মূল চাবিকাঠি। এটি সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ উভয় প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং সুস্থ ও দীর্ঘায়ু জীবন নিশ্চিত করে।

৬. টিকা গ্রহণ

টিকা গ্রহণ সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। বাংলাদেশে সরকার ও স্বাস্থ্য সংস্থা শিশুদের জন্য নানারকম টিকা প্রদান করে, যেমন বাচ্চাদের হেপাটাইটিস বি, ডিপথেরিয়া, টিটানাস, কাশি এবং পোলিও। এগুলো শিশুর জীবনের প্রথম দিকেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে।

টিকা শরীরকে রোগের বিরুদ্ধে প্রস্তুত করে। যখন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটায়, তখন শরীর আগেই রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত থাকে। এই প্রক্রিয়াকে ইমিউনিটি বলা হয়। যথাসময়ে টিকা না নিলে সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

শিশুদের জন্য নিয়মিত ভ্যাকসিনেশন খুব জরুরি। জন্মের পর ২৪ ঘন্টার মধ্যে হেপাটাইটিস বি টিকা দেওয়া হয়। পরে নির্দিষ্ট সময় অন্তর বাকি টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এটি শিশুদের জন্য জীবন রক্ষার হাতিয়ার।

প্রাপ্তবয়স্করাও টিকা নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্লু টিকা, হেপাটাইটিস, ডেঙ্গু সচেতনতা ও অন্যান্য ভ্যাকসিন প্রাপ্তবয়স্কদের সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যকর্মী ও ভ্রমণকারীদের টিকা গ্রহণ অপরিহার্য।

টিকা গ্রহণের মাধ্যমে মহামারী নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ডেঙ্গু, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হেপাটাইটিস এবং অন্যান্য ভাইরাসজনিত রোগের বিস্তার রোধ করা যায়। তাই জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও টিকার যথাসময়ে গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।

শিশুদের টিকা রেকর্ড সংরক্ষণ করা উচিৎ। কোন টিকা নেওয়া হয়েছে এবং পরবর্তী ডোজের সময়সূচি জানা থাকলে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সুসংহত থাকে।

টিকা সংক্রান্ত ভুল ধারণা দূর করা জরুরি। অনেকেই মনে করেন টিকা নেওয়া শিশুর জন্য ক্ষতিকর, যা ভুল। সরকারি স্বাস্থ্য নির্দেশিকা অনুযায়ী, নিরাপদ ও কার্যকর টিকা রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।

নাগরিক ও পরিবারের দায়িত্ব হলো শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সময়মতো টিকা নিশ্চিত করা। স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ক্লিনিকে নিয়মিত পরামর্শ ও টিকা গ্রহণ করা উচিত।

টিকা গ্রহণ শুধু ব্যক্তিগত সুরক্ষা নয়, সমাজের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। যখন অধিকাংশ মানুষ টিকা নেন, তখন herd immunity তৈরি হয় এবং সংক্রামক রোগের বিস্তার কমে।

৭. ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকা

ধূমপান ও মদ্যপান অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশে অনেকেই সামাজিক ও মানসিক চাপের কারণে ধূমপান বা মদ্যপান করেন, যা দীর্ঘমেয়াদে হার্টের সমস্যা, ক্যান্সার, লিভারের অসুখ এবং ফুসফুসের রোগ সৃষ্টি করে। এই অভ্যাস শুধু ব্যক্তিকে নয়, পারিপার্শ্বিক মানুষকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

ধূমপানের ফলে ফুসফুসে তামাকের ক্ষতিকর পদার্থ জমে, যা দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সার ও শ্বাসকষ্টের কারণ হয়। যাদের ধূমপান করার অভ্যাস আছে, তাদের সংক্রামক রোগ যেমন ফ্লু, টিউবারকুলোসিস এবং শ্বাসনালী সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে।

মদ্যপান লিভার, কিডনি ও হৃদপিণ্ডের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত মদ্যপান হজমের সমস্যা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। শিশু ও পরিবারের ওপরও এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে।

ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকা মানে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। যারা এই অভ্যাস ত্যাগ করেন, তারা কম সময়ে সুস্থ থাকেন এবং সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকেন।

সামাজিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি করলে ধূমপান ও মদ্যপান কমানো সম্ভব। স্কুল, কলেজ ও অফিস পর্যায়ে ক্যাম্পেইন, শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম ও পরিবারিক সচেতনতা এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

তুলনামূলকভাবে, যারা ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করেন, তাদের হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার এবং অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি অনেক কম থাকে। এটি দীর্ঘায়ু ও স্বাস্থ্যকর জীবন নিশ্চিত করে।

শিশু ও কিশোরদের মধ্যে ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস প্রতিরোধ করা জরুরি। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিশুদের সচেতন করা, স্বাস্থ্যকর বিকল্প প্রদর্শন করা এবং মানসিক সমর্থন দেওয়া প্রয়োজন।

সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করলে পরিবার ও সমাজের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

পরিশেষে বলা যায়, ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকা সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্য অপরিহার্য। এটি ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষা করে এবং সমাজের জন্যও দীর্ঘমেয়াদে উপকারি।

৮. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধের অন্যতম কার্যকর উপায়। বাংলাদেশে অনেক মানুষ শুধুমাত্র অসুস্থ হলে চিকিৎসকের কাছে যায়, কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলে রোগের আগেভাগে সনাক্তকরণ সম্ভব। এতে চিকিৎসা সহজ ও দ্রুত হয় এবং জটিলতা কমে।

শিশুদের জন্য ভ্যাকসিনেশন, ওজন, উচ্চতা, পুষ্টি ও বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করলে ডায়রিয়া, পোলিও বা অন্যান্য সংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমে। এছাড়া বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশও সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকে।

প্রাপ্তবয়স্ক ও বয়স্কদের জন্য উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল এবং হৃদরোগের পরীক্ষা নিয়মিত করা জরুরি। অনেক সময় মানুষ স্বাস্থ্যগত সমস্যা অনুভব না করলেও শরীরে সমস্যা চলে। নিয়মিত পরীক্ষা আগেভাগে রোগ শনাক্ত করে প্রতিরোধে সহায়তা করে।

গর্ভবতী মহিলাদের জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা অপরিহার্য। প্রেগন্যান্সি চেকআপের মাধ্যমে মাতৃত্বকালীন সমস্যা, শিশুর স্বাস্থ্য এবং সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হয়। হিমোগ্লোবিন, রক্তচাপ, প্রসবকালীন রোগ পরীক্ষা করতে হবে।

প্রতিদিন ছোট ছোট লক্ষণ উপেক্ষা করা উচিত নয়। মাথা ঘোরা, বারবার জ্বর, খাওয়ার অভ্যাস পরিবর্তন, অস্বাভাবিক ওজন হ্রাস—এসব পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। রোগের প্রাথমিক চিহ্ন ধরা গেলে প্রতিরোধ কার্যকর হয়।

শহরাঞ্চলে ল্যাব, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা সহজলভ্য হলেও গ্রামে এই সুবিধা সীমিত। তাই সরকারি উদ্যোগ ও মোবাইল ক্লিনিক ব্যবহার করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো জরুরি।

নিয়মিত দাঁতের পরীক্ষা ও চোখের পরীক্ষা স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দাঁতের সমস্যা মুখে সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে, এবং চোখের সমস্যা দীর্ঘমেয়াদে জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে।

শিশু থেকে বয়স্ক পর্যন্ত সকল বয়সের মানুষকে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। পরিবারিক ইতিহাস ও জিনগত সমস্যা থাকলে বিশেষ পরীক্ষা প্রয়োজন।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা মানে শুধু রোগ শনাক্ত নয়, এটি স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করে। মানুষ নিজের জীবনধারার উন্নতি করতে পারে এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনে।

পরিশেষে বলা যায়, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে এক কার্যকর হাতিয়ার। এটি ব্যক্তির জীবনমান উন্নত করে এবং পরিবার ও সমাজকে সুস্থ রাখে।

৯. জনসচেতনতা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা

জনসচেতনতা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা সংক্রামক এবং অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। বাংলাদেশে অনেক মানুষ এখনও রোগপ্রতিরোধমূলক বিষয় সম্পর্কে সচেতন নয়। অনেক সময় ভুল খাদ্যাভ্যাস, দূষিত পানি, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং sedentary lifestyle রোগের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জনসচেতনতা বাড়ালে এসব ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

স্কুল, কলেজ এবং কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে স্বাস্থ্যশিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা জরুরি। শিশুদের ছোটবেলা থেকে স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষাদান তাদের জীবনধারায় পরিবর্তন আনে। হাত ধোয়া, সুষম খাদ্য, ব্যায়াম এবং টিকা গ্রহণের গুরুত্ব বোঝানো হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও টেলিভিশনেও স্বাস্থ্যসচেতনতা প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ। জনগণ সহজ ভাষায় সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধের পদ্ধতি শিখতে পারে। ভিডিও, পোস্টার, আর্টিকেল এবং কমিউনিটি সেমিনার স্বাস্থ্যবোধ বৃদ্ধি করে।

গ্রামে স্বেচ্ছাসেবী ও স্বাস্থ্যকর্মী জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে। তারা শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে পরিচ্ছন্নতা, বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং টিকা গ্রহণের গুরুত্ব বোঝাতে পারে।

পরিবার পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। পিতামাতা শিশুদের স্বাস্থ্যকর অভ্যাসে অভ্যস্ত করলে ভবিষ্যতে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমে। একইভাবে পরিবারে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করলে মানসিক চাপ কমে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় থাকে।

শহরাঞ্চলে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আবর্জনা ও পানি দূষণ, সঠিক স্যানিটেশন, ধূমপান ও মদ্যপান নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে মানুষকে শিক্ষা দিতে হবে। সমাজে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধ করা যায়।

স্বাস্থ্যবিমা, সরকারি স্বাস্থ্য নীতি ও স্থানীয় স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থার সঙ্গে সচেতনতা মিলিয়ে রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়। জনগণ যদি নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসা গ্রহণে সচেতন হয়, তা দীর্ঘমেয়াদে রোগ কমায়।

আরোও পড়ুনঃ  রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসার কারণ সমূহ

পরিশেষে, জনসচেতনতা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা হলো সুস্থ সমাজ গঠনের মূল ভিত্তি। স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখতে শিক্ষিত এবং সচেতন মানুষ অপরিহার্য। প্রতিটি পরিবার, স্কুল, কমিউনিটি এবং সরকারকে এই ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

একটি সুস্থ জাতি গড়ে তোলা সম্ভব, যখন মানুষ সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধের পদ্ধতি জানে এবং সেগুলো নিয়মিত বাস্তবায়ন করে। সচেতন সমাজই স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যতের guarantor।

১০. প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখা

প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ রক্ষা সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে নদী, খাল, বনাঞ্চল এবং শহরাঞ্চলের দূষণ ও আবর্জনার কারণে নানা রোগের বিস্তার ঘটে। স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করলে মানুষ দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ থাকে এবং রোগের ঝুঁকি কমে।

পরিবেশ দূষণ যেমন পানির দূষণ, বায়ু দূষণ এবং ময়লা-আবর্জনা সংক্রমণ বৃদ্ধি করে। দূষিত পানি ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েডের মতো সংক্রামক রোগের কারণ হয়। বায়ু দূষণ ফুসফুসের সমস্যা ও হাঁপানি সৃষ্টি করে।

পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য আবর্জনা সঠিকভাবে ফেলা অপরিহার্য। বাসা, স্কুল, অফিস এবং আশেপাশের জায়গা নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এতে মশা ও ব্যাকটেরিয়ার জন্ম কমে এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

সবুজায়ন ও গাছপালা রক্ষা স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করে। গাছ বায়ু শুদ্ধ রাখে, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং মানসিক স্বস্তি প্রদান করে। শিশুদের জন্য সবুজ খেলার জায়গা অপরিহার্য।

নদী, খাল ও পুকুরের পানি দূষণ রোধ করতে স্থানীয় কমিউনিটি ও সরকারকে যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে। জলজ জীব বৈচিত্র্য রক্ষা করা সংক্রমণ কমাতে সহায়ক।

শহরাঞ্চলে শিল্প কারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া দূষণ নিয়ন্ত্রণ জরুরি। সরকারি নিয়মনীতি অনুসরণ ও নাগরিক সচেতনতা পরিবেশের মান উন্নত করে।

পরিবারের মধ্যে পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখা জরুরি। রান্নাঘর, বাথরুম, শৌচাগার এবং খেলাধুলার স্থান নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। শিশুরা ছোটবেলা থেকে পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতন হলে দীর্ঘমেয়াদে সংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমে।

পানির সঠিক সংরক্ষণ, আবর্জনা ব্যবস্থাপনা, ব্যাকটেরিয়া ও মশার নিয়ন্ত্রণ স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অংশ। এটি শুধু সংক্রমণ প্রতিরোধে নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

পরিশেষে বলা যায়, প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখা সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে অপরিহার্য। এটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গড়ে তোলে, পরিবার ও সমাজকে সুস্থ রাখে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে।

সংক্রামক রোগ ও অসংক্রামক রোগের পার্থক্য

Infectious and non-communicable diseases4

রোগকে সাধারণভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায় – সংক্রামক এবং অসংক্রামক। সংক্রামক রোগ হলো এমন রোগ যা একটি ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে ছড়ায়, মূলত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস বা প্যারাসাইটের মাধ্যমে। অপরদিকে অসংক্রামক রোগ সংক্রমিত নয়, বরং ধীরে ধীরে শরীরের ভেতরের সমস্যা, জীবনধারা বা জিনগত কারণে হয়।

সংক্রামক রোগের উদাহরণ হলো ডায়রিয়া, টাইফয়েড, কলেরা, ডেঙ্গু, হেপাটাইটিস এবং ফ্লু। এগুলো সাধারণত দ্রুত ছড়ায় এবং কখনও কখনও মহামারীর আকার নিতে পারে। অসংক্রামক রোগের মধ্যে আছে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যান্সার, হাঁপানি, কিডনি রোগ এবং ওজনজনিত সমস্যা। এগুলো ধীরে ধীরে শরীরে বিকাশ পায়।

সংক্রামক রোগ সাধারণত সংক্রমণ দ্বারা ছড়ায়। এটি হতে পারে বাতাস, পানি, খাদ্য, শারীরিক সংস্পর্শ বা জীবাণুমুক্ত না থাকা পরিবেশের মাধ্যমে। অসংক্রামক রোগ সংক্রমণ ছড়ায় না। এগুলো শরীরের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন, জীবনধারা ও জেনেটিক কারণে হয়।

সংক্রামক রোগ দ্রুত দেখা দেয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে শরীরকে প্রভাবিত করতে পারে। অসংক্রামক রোগ সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে বিকাশ হয় এবং দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতা, বিশুদ্ধ পানি, টিকা গ্রহণ, হাত ধোয়া এবং জনসচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সুষম খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা, পর্যাপ্ত ঘুম এবং ধূমপান-মদ্যপান পরিহার গুরুত্বপূর্ণ।

সংক্রামক রোগে বাহ্যিক উপসর্গ যেমন জ্বর, কাশি, পাতলা পায়খানা বা রক্তপাত দ্রুত দেখা যায়। অসংক্রামক রোগে উপসর্গ ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়, যেমন ওজন বৃদ্ধি, উচ্চ রক্তচাপ, পেশীর দুর্বলতা বা স্থায়ী ব্যথা।

শিশু, বয়স্ক এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা মানুষ সংক্রামক রোগের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য, sedentary lifestyle এবং মানসিক চাপ থাকলে।

চিকিৎসা পদ্ধতিও ভিন্ন। সংক্রামক রোগে অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল ও অন্যান্য সংক্রমণনাশক ওষুধ কার্যকর। অসংক্রামক রোগে জীবনধারা পরিবর্তন, দীর্ঘমেয়াদী ওষুধ এবং নিয়মিত চিকিৎসা প্রয়োজন।

সংক্রামক রোগ প্রায়ই এক সম্প্রদায়ে দ্রুত ছড়ায়, তাই herd immunity ও জনসচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ। অসংক্রামক রোগ সাধারণত সমাজে দ্রুত ছড়ায় না, তবে যদি মানুষ সচেতন না হয়, স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে।

পরিশেষে বলা যায়, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো সংক্রমণযোগ্যতা, রোগের প্রকৃতি, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং প্রতিরোধের উপায়। উভয়ই সঠিক সচেতনতা ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ 

সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে করণীয়?  এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-

সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের মধ্যে মূল পার্থক্য কী?

সংক্রামক রোগ হলো এমন রোগ যা একটি ব্যক্তির থেকে অন্য ব্যক্তিতে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা প্যারাসাইটের মাধ্যমে ছড়ায়। যেমন: ডায়রিয়া, ডেঙ্গু, হেপাটাইটিস। অপরদিকে অসংক্রামক রোগ সংক্রমণ ছড়ায় না, বরং ধীরে ধীরে জীবনধারা, জিনগত কারণ বা শরীরের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে হয়। যেমন: ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার। সংক্রামক রোগ দ্রুত প্রভাব ফেলে, অসংক্রামক রোগ ধীরে ধীরে বিকাশ হয়।

সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্য কী কী করা উচিত?

প্রতিরোধের জন্য প্রথমে স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখা জরুরি। নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা প্রয়োজন। সংক্রামক রোগের জন্য হাত ধোয়া, পরিচ্ছন্নতা, বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার এবং টিকা গ্রহণ অপরিহার্য। অসংক্রামক রোগের জন্য ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং মানসিক চাপ কমানো সহায়ক। এছাড়া পরিবার ও সমাজে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করলে প্রতিরোধ কার্যকর হয়।

উপসংহার

সংক্রামক এবং অসংক্রামক রোগ আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সঠিক তথ্য, সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করলে উভয় রোগই প্রতিরোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশে আমাদের পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে এই রোগের বিস্তার এবং প্রভাব। তাই ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজের সবাইকে সচেতন হতে হবে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবনধারা, বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়াম রোগ প্রতিরোধে অপরিহার্য। এসব অভ্যাস আমাদের দেহকে শক্তিশালী করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। সুষম খাদ্য ও পর্যাপ্ত ঘুম শরীর ও মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে, যা অসংক্রামক রোগ কমাতে সহায়ক।

টিকা গ্রহণ সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের জন্য যথাসময়ে টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা স্বাস্থ্যকর জীবনধারার মূল ভিত্তি।

জনসচেতনতা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা সমাজকে সুস্থ রাখে। মানুষকে সঠিক তথ্য প্রদান করে এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাসে অভ্যস্ত করলে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে। পরিবার ও কমিউনিটির দায়িত্ব হলো শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাইকে স্বাস্থ্য সচেতন করা।

প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখা দীর্ঘমেয়াদী রোগ প্রতিরোধে অপরিহার্য। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, সবুজায়ন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং আবর্জনা ব্যবস্থাপনা সংক্রমণ রোধে সহায়তা করে এবং মানসিক শান্তি প্রদান করে।

সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের পার্থক্য বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। সংক্রামক রোগ সংক্রমণযোগ্য এবং দ্রুত ছড়ায়, কিন্তু অসংক্রামক রোগ ধীরে ধীরে বিকাশ ঘটে এবং জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়। উভয়ের ক্ষেত্রেই সঠিক সচেতনতা প্রয়োজন।

সঠিক জীবনধারা মানলে, নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত ঘুম, টিকা গ্রহণ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং মানসিক শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, এবং মানুষ সুস্থ ও দীর্ঘায়ু জীবন যাপন করতে পারে।

পরিবার, সমাজ এবং সরকার একত্রিতভাবে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরিকদের সুস্থ রাখতে পারে। শিক্ষামূলক কর্মসূচি, স্বাস্থ্য ক্যাম্পেইন এবং সরকারি নীতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করলে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের বিস্তার কমানো সম্ভব।

পরিশেষে বলা যায়, স্বাস্থ্যকর জীবনধারা, পরিচ্ছন্নতা, জনসচেতনতা এবং সঠিক চিকিৎসা প্রাপ্তির মাধ্যমে আমরা সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ উভয়ই প্রতিরোধ করতে পারি। স্বাস্থ্য মানেই জীবন মান; সুস্থ দেহ ও মনের মাধ্যমে আমরা পরিবার ও সমাজকে নিরাপদ ও সুস্থ রাখতে পারি।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *